সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা ও সূরা ইখলাস | দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা



দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনাকে সংক্ষিপ্ততম উপায়ে প্রকাশ করেছে কুরআন, সূরা ইখলাস-এ। “ব্যাকট্র্যাকিং” পর্ব থেকে শুরু করে একটু একটু করে অগ্রসর হয়ে “একাধিক স্রষ্টা” পর্বে এসে “পরম স্রষ্টার” ব্যাপারে আমরা মোটামুটিভাবে পাঁচটি অকাট্য সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম:

১. তিনি অসৃষ্ট। অতএব, তিনি জন্মগ্রহণ করেননি।

২. তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে। ইনফিনিটিতে তাঁর বাস। তিনিই ইনফিনিটি।

৩. তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা আছে। তিনি শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারেন।

৪. তিনি মহাবিশ্বের পরম স্রষ্টা: তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন।

৫. তিনি সংখ্যার ঊর্ধ্বে। তিনি একক, অবিভাজ্য।

আর সূরা ইখলাস সে কথাগুলিরই প্রতিধ্বনি করছে। সূরা ইখলাস বলছে যে, তিনি একক (আহাদ)। আরো বলছে যে, তিনি কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেননি বা কাউকে জন্মও দেননি (লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইয়ুলাদ)।

এই দুইটি পয়েন্ট আমাদের দার্শনিক স্রষ্টাভাবনার সিদ্ধান্তের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। এবং বাকি দুটি যে বাক্য, তা-ও আসলে আমাদের সিদ্ধান্তগুলোরই অনুসিদ্ধান্ত: আল্লাহ অমুখাপেক্ষী (আল্লাহুস সামাদ), এবং তাঁর সমতুল্য কোনো কিছুই নেই (ওয়ালাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ)। তাঁর সমতুল্য থাকবে কিভাবে, তাঁর দ্বিতীয়টা থাকলে না তুলনা করা যাবে! দুইজন মানুষের মাঝে তুলনা হয়, কিন্তু দুইজন পরম স্রষ্টাই তো নাই যে তুলনা করবেন! এ নিয়ে আমরা “একাধিক স্রষ্টা” পর্বে আলোচনা করেছি।

একজন মুক্তমনা দার্শনিক হন সত্যিকার নিরপেক্ষ মানুষ। তিনি কোনো ধর্মের পক্ষেও নাই, বিপক্ষেও নাই। তিনি কেবল দার্শনিক উপায়ে সত্যের সন্ধান করেন; এবং যার সাথে যেখানে যতটুকু সত্য মিলে যায়, ততটুকু গ্রহণ করেন। তেমনি একজন মুক্তমনা দার্শনিক যখন তার “দার্শনিক স্রষ্টাভাবনার” সাথে সূরা ইখলাসের এমন বিস্ময়কর মিল খুঁজে পান, তখন কুরআনের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক।সেই আগ্রহ আরো বেড়ে যায়, যখন জানা যায় যে কুরআন ১৪০০ বছর আগের একটি গ্রন্থ। শুধু তা-ই নয়, এমন এক মহা দার্শনিক গ্রন্থের জন্য নিজে কোনোই ক্রেডিট দাবী করেননি মুহাম্মদ। বরং কুরআনের ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়েছে যে, এটি পরম স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসা এক কিতাব; এর মাধ্যমে তিনি (আল্লাহ) মানুষকে বের করে আনেন (নবীর মাধ্যমে) অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। তবে এ কেমন নিঃস্বার্থ লেখক, যার বিন্দুমাত্র খ্যাতির মোহ নেই? সুবিশাল এক গ্রন্থ নিজে লিখবে, অথচ তার ক্রেডিট নেবে না, বরং বলবে সেটা পরম স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসা বাণী – এটা কি আদৌ সম্ভব? তার মানে কি কুরআন মুহাম্মদের লেখা গ্রন্থ নয়, বরং প্রকৃতপক্ষেই কুরআন আল্লাহর বাণী? একজন মুক্তমনা দার্শনিকের মনে ইত্যাদি নানান প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।

দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা ও সূরা ইখলাস | দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা


আর এতসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে কুরআন হাতে তুলে নেবার বিকল্প নেই। আজ থেকে পাঁচবছর আগে আমি সেভাবেই কুরআন হাতে তুলে নিয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি অস্বীকার করব না, তার আগেও আমি কুরআন পড়েছি। কিন্তু তখন সেটা ছিল আমার কাছে ধর্মগ্রন্থ: যার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তখনও আমি সমাজ-পরিবারের বিপরীতে যাবার সাহস অর্জন করিনি। তখনও সত্যের সন্ধানে নিরপেক্ষ দার্শনিক যাত্রা করিনি। তখন যখন কুরআন পড়তাম, পড়তাম নিজের ধর্মকে জানার জন্য। এবং আরো একটা কারণে কুরআন পড়তাম: আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কে নিজের ধর্মকে জিতানোর জন্য। কিন্তু তর্কে জিতে আসলে কী হবে, দিনশেষে আমার নিজের কাছে আমি শূন্য: ইসলামই যে সত্য, তা আমি নিশ্চিত নই। সত্য যে আসলে কোনটা, তা-ই আমি জানি না। আমার নিজের ভিতরেই কোনো দৃঢ়তা নেই।

তারপর একটা সময়ে ব্যক্তিগত কিছু ঘটনায় যখন নিজের ভিতরে প্রবলভাবে আন্দোলিত হলাম, ধাক্কা খেলাম, তখন সত্যের সন্ধানে নিরপেক্ষ দার্শনিক যাত্রা করবার সাহস করে ফেললাম। আর সেই যাত্রার গল্পটাই আপনি এতক্ষণ পড়ছেন, প্রিয় পাঠক!

পাঠক! হয়ত আপনার দার্শনিক যাত্রাটা ভিন্নরকম হবে। হয়ত আমি যেভাবে স্রষ্টাভাবনা করেছি, আপনি সেভাবে করবেন না। হতেই পারে! তবে উৎসের সন্ধান করাটা যে মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতএব, কোনো মানুষ এই বইটি পড়ুক বা না-ই পড়ুক, কুরআন পড়ুক বা না-ই পড়ুক, সে-ও স্রষ্টাভাবনা করবে। সেও উৎসের সন্ধান করবে। যে মানুষ বই পড়তে জানে না, কোনো ধর্মের ব্রেইনওয়াশিংও নেই, সে-ও তো উৎসের সন্ধান করে!

আবারো বলছি, পাঠক! হয়ত আপনার কিংবা আরেকজন মানুষের দার্শনিক যাত্রাটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত দার্শনিক যাত্রার যে গল্প, তাতে কুরআনের একটি অংশ আছে। প্রশ্ন আসতে পারে, কেন কুরআন? কেন অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়? উত্তরে বলতে হয়, কুরআনের বাইরে কমপক্ষে বাইবেল নিয়ে পড়াশুনা লেখকের আছে। কিন্তু যদি দশটা ধর্মগ্রন্থ যাচাইয়ের পর বাইবেলকেই সঠিক বলে পাওয়া যায়, তবে কেবল বাইবেলের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করাই সঙ্গত। নতুবা বই বিশাল আকার ধারণ করবে। একইভাবে তা যদি হয় কুরআন, তবে প্রথমেই “কুরআন যাচাই” এর অংশটুকু তুলে ধরাই কাম্য।

সত্য লুকিয়ে নেই, লুকিয়ে নেই পরম স্রষ্টাও। বরং জীবন-জগতের মহাসত্য জানবার পথে বাধা হলাম আমরা নিজেরাই: আমাদের প্রভাবিত মন। আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক, বিভিন্ন আন্তঃধর্মীয় বিতর্ক, আর সেসব বিতর্কে নিজের দলকে জিতানোর চেষ্টা – এইসব করে করে আমরা নিজেদের মনকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করে ফেলেছি। আমরা আস্তিক-নাস্তিক প্রত্যেকেই কতটা যে ব্রেইনওয়াশড, তা অনুভব করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি অনেকে। চারিদিকে প্রভাবিত মনের মানুষদের ধর্মীয় তর্ক বিতর্কের স্রোতের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নিজের মত করে সত্যের সন্ধানে যাত্রা করাটা সত্যিই কঠিন। সেই কঠিন কাজটি করার জন্য আপনাকে স্বাগতম।

পাঁচ বছর আগে কুরআনের ভিতরে যে দার্শনিক যাত্রা শুরু করেছিলাম, তা আজও চলছে। আমার সেই যাত্রারই কিছু গল্প নিয়ে এই বইয়ের দ্বিতীয় ভাগ: দার্শনিকের কুরআন যাত্রা।

_______________________________

অসৃষ্ট | সময়ের ঊর্ধ্বে | সংখ্যার ঊর্ধ্বে | ইনফিনিটি

সূরা ইখলাস



মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক জনপ্রিয়

স্রষ্টাভাবনা

প্রথম ভাগ: দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা  | | পর্ব-১: উৎসের সন্ধানে উৎসের সন্ধান করা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। মানুষ তার আশেপাশের জিনিসের উৎস জানতে চায়। কোথাও পিঁপড়ার লাইন দেখলে সেই লাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে পিঁপড়ার বাসা খুঁজে বের করে। নাকে সুঘ্রাণ ভেসে এলে তার উৎস খোঁজে। অপরিচিত কোনো উদ্ভিদ, প্রাণী কিংবা যেকোনো অচেনা জিনিস দেখলে চিন্তা করে – কোথা থেকে এলো? কোথাও কোনো সুন্দর আর্টওয়ার্ক দেখলে অচেনা শিল্পীর প্রশংসা করে। আকাশের বজ্রপাত, বৃষ্টি, রংধনু কিংবা সাগরতলের অচেনা জগৎ নিয়েও মানুষ চিন্তা করে। এমনকি ছোট শিশু, যে হয়তো কথাই বলতে শেখেনি, সে-ও কোনো শব্দ শুনলে তার উৎসের দিকে মাথা ঘুরায়। অর্থাৎ, মানুষ জন্মগতভাবেই কৌতুহলপ্রবণ। একটা বাচ্চা জ্ঞান হবার পর চিন্তা করে – আমি কোথা থেকে এলাম? আরো বড় হবার পর চিন্তা করে – আমার মা কোথা থেকে এলো? এমনি করে একসময় ভাবে, পৃথিবীর প্রথম মা ও প্রথম বাবা, অর্থাৎ আদি পিতা-মাতা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল? চারিদিকের গাছপালা, প্রকৃতি, পশুপাখি, গ্রহ-নক্ষত্র-মহাবিশ্ব – এগুলিরই বা সৃষ্টি হয়েছে কিভাবে? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন উৎসুক মনে খেলে যায়। তখনই শুরু হয় সমস্যা। নির

খোদার ন্যায়বিচার | অনন্তের পথে

আগের পর্ব: আল্লাহ কেন পথভ্রষ্ট করেন? | সূচীপত্র দেখুন প্রশ্ন: এমনও অনেকে আছে, যারা ইসলামের নামও শোনেনি, যাদের কাছে কুরআন পৌঁছায় নাই, তাদের কী হবে? তারা কেন জাহান্নামে যাবে? তাদের কী দোষ? কোথায় খোদার ন্যায়বিচার? নাস্তিকদের একটা কমন প্রশ্ন এটা। এবং প্রশ্নটা অবশ্যই অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মুসলমানই ইসলামকে যৌক্তিক ও দার্শনিক মানদণ্ডে যাচাই করে তারপর সত্য হিসেবে গ্রহণ করে মানে না, বরং তারা মানে বাপ-দাদার ধর্ম হিসেবে, (অন্ধ)বিশ্বাসের বস্তু হিসেবে। আর তাই এসকল প্রশ্নের যৌক্তিক সত্য জবাবও তারা দিতে পারেন না। দেবেনই বা কিভাবে, নিজেই তো জানেন না! উপরন্তু নিজের (অন্ধ)বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার জন্য গোঁজামিলে পরিপূর্ণ ভুলভাল ব্যাখ্যা হাজির করেন। তাই তারা বলেন, “মুসলমান না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না। অমুসলিম মাত্রেই জাহান্নামী”, ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ একটা পতিতালয়ে যে মেয়েটির জন্ম হয়, সে মেয়েটি কী দোষ করেছিল তাহলে? ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এমন সব প্রশ্নকে দূরে ঠেলে “মুসলিম না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না ব্যস” বলে বসেন। অথচ জন্ম ও বেড়ে ওঠার উপর কারো হাত নেই। দুনিয়ার প্রতিটা মানুষই ভিন্ন ভ

আত্মদর্শন | অনন্তের পথে

আগের পর্ব: জ্ঞানের জগত ও হৃদয়ের জগত | সূচীপত্র দেখুন আমি কে? “I am not this hair, not this skin But the soul that lies within.” - Maulana Rumi আমি কে - এই প্রশ্ন যুগে যুগে দার্শনিকদেরকে চিন্তিত করেছে। অনেকে বলেছে, মানব মস্তিষ্কেই কেবল আমিত্বের অনুভূতি বিদ্যমান। কথা হয়ত সত্য। তবে যেহেতু তারা ক্বলবের জগত সম্পর্কে বেখবর, তাই তারা তাদের সীমিত জ্ঞানবৃত্তের ভিতরেই উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে। মানুষের আত্মা হলো আসল খলিফা وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ (١٧٢) أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ (١٧٣) “আর (হে রাসূল!) যখন আপনার রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বহির্গত করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং তাদের নিজের ওপর তাদেরকে সাক্ষ্য করলেন; (তাদেরকে প্রশ্ন করলেন,) আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল, অবশ্যই, আ