সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কুরআন কি যুক্তিবাদী? | দার্শনিকের কুরআন যাত্রা



অনেকে বলে: “দেখো, ধর্ম হলো বিশ্বাসের বিষয়, এখানে যুক্তি খুঁজলে হবে না।” দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রচলিত প্রায় সকল ধর্মের অনুসারীর মাঝেই কমবেশি এই ধারণা প্রচলিত আছে। অথচ যুক্তি হলো দর্শনের প্রধান হাতিয়ার। যুক্তিতর্ক না করলে আমরা কিভাবে দার্শনিক স্রষ্টাভাবনা করতাম? আর কিভাবেই বা পরম স্রষ্টাকে চিনতাম? যদি যুক্তিতর্ক না-ই করব, তাহলে তো সবাই যার যার ধর্মের মধ্যেই থেকে যেত; এক ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে আসতে পারত না। কিংবা নাস্তিকরাও আস্তিক হতে পারত না।

একজন হিন্দু যদি বলে যে, দেখো এই মূর্তি আমার ভগবান, এটা আমার বিশ্বাস, অতএব এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। একইভাবে খ্রিষ্টান যদি বলে যে, দেখো, যীশু হলো খোদার পুত্র, ব্যস, এটা আমার বিশ্বাস; স্রষ্টার পুত্র হওয়া সম্ভব কিনা, এই নিয়ে যুক্তিতর্ক আমি করব না, কারণ ধর্ম হলো বিশ্বাসের বিষয়, যুক্তির বিষয় নয়। একইভাবে মুসলিম যদি বলে যে দেখো, কুরআনকে যুক্তি দিয়ে যাচাই করলে হবে না, তোমাকে এটা বিশ্বাস করতে হবে। আর নাস্তিক যদি বলে যে, দেখো, বিজ্ঞানীরা যা বলবে, সেটাই বিশ্বাস করতে হবে।

এইভাবে যদি সবাই গোঁড়ামি করে, তাহলে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কী হবে? যাচাই না করলে কিভাবে বুঝব কোনটা সত্য?

কী আশ্চর্য যে, এসব মানুষ একইসাথে স্রষ্টায় বিশ্বাস করে, আবার যুক্তির বিরোধিতা করে! অথচ স্রষ্টাই আমাদেরকে যুক্তিবাদী করে সৃষ্টি করেছেন। উৎসের সন্ধান করা যেমন মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য, তেমনি যুক্তি দিয়ে যাচাই-বাছাই করাও মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। সেটা আমরা দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনাতেই দেখেছি।

ব্যাকট্র্যাকিং অধ্যায়ে আমরা শুরুই করেছিলাম এই যুক্তি দিয়ে যে: আমার মা, তার মা, তার মা… এভাবে পিছনে যেতে যেতে অবশ্যই একজন আদি মাতা থাকতে হবে, যার কোনো মা নেই, বরং যাকে সরাসরি সৃষ্টি করা হয়েছে। একইভাবে আদি স্রষ্টা তথা পরম স্রষ্টার প্রমাণও আমরা যুক্তি দিয়েই দিয়েছিলাম। অতএব, এটা স্বীকার করতেই হবে যে, যুক্তি হলো পরম স্রষ্টাকে পাবার প্রধান হাতিয়ার।

তো, যেহেতু দেখা যাচ্ছে যে যুক্তি তথা intellectual reasoning হলো স্রষ্টাকে পাবার দুয়ার, তাহলে কুরআনকে অবশ্যই এটার সমর্থনে কথা বলতে হবে। অন্ততঃ এমন কোনো কথা কুরআনে থাকা চলবে না যে: “তোমরা অন্ধভাবে আমার সব কথা মেনে নাও, কোনো চিন্তা করবে না, যুক্তিতর্ক করবে না, বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করবে না, তোমার চিন্তা করার কোনো অধিকার নেই, প্রশ্ন করার অধিকার নেই।” এরকম কথা যদি থাকে, তাহলে কুরআনই বাদ দিয়ে দেব আমরা। যতই সূরা ইখলাস আর উদারতার দর্শন থাকুক না কেন, আমরা আর যাচাই-ই করব না। কেননা ঐটা তাহলে গোঁড়ামির জায়গা, উদারমনা দার্শনিকের মুক্তিবুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্র নয়।

অতএব, কুরআনকে অবশ্যই দর্শন, যুক্তি, বিচারবুদ্ধি, মুক্তবুদ্ধি ইত্যাদির সমর্থক হতে হবে। এবার আমরা দেখি, কুরআন এমন কিছু বলে কিনা? অর্থাৎ, কুরআন কি মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে নিষেধ করে, নাকি সমর্থন করে?

বাপ-দাদার দেখাদেখি ধর্মপালন করা যাবে না


وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنْزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلا يَهْتَدُونَ (١٧٠)

“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তার অনুসরণ করো’, তখন তারা বলে, ‘বরং আমরা তারই অনুসরণ করবো যার ওপর আমাদের পিতৃপুরুষদের পেয়েছি।’ তাদের পিতৃপুরুষরা যদি মোটেই বিচারবুদ্ধি ব্যবহার না করে থাকে এবং সঠিক পথ (হেদায়াত) প্রাপ্ত না হয়ে থাকে (তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে)?” (সূরা বাকারা, ২:১৭০)

উপরের আয়াতে দেখুন বাপ-দাদার দেখাদেখি ধর্মপালনের বিপরীতে আল্লাহপাক যুক্তি দিচ্ছেন। অর্থাৎ, আয়াতটার অন্তর্নিহিত ভাবটা এরকম: “যদি” তাদের বাপ-দাদারা ভুলের উপর থাকে, “তাহলে” বাপ-দাদার দেখাদেখি ধর্মপালন করে সেও ভুলের উপরেই থাকবে।

প্রিয় পাঠক! এবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আমাদের দার্শনিক যাত্রার একদম গোড়ার দিকের কথা। সেখানে আমরা বলেছিলাম যে, সত্য জানতে হলে নিজেকে নিরপেক্ষ করতে হবে। নিরপেক্ষতার স্বার্থে আপনি হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান যা-ই হোন না কেন, ঐ ধর্মের সব চিন্তাকে আগে মাথা থেকে সরাতে হবে। অর্থাৎ, বাপ-দাদার দেখাদেখি যে ধর্ম আমরা পালন করে আসছি, তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এরপর নিরপেক্ষভাবে সত্যের সন্ধান করতে হবে। আর দেখুন, কুরআনও সেকথাই বলছে। বাপ-দাদার ধর্মের অন্ধ অনুসরণ করতে নিষেধ করছে। অর্থাৎ, আমরা যেই ধর্মের মানুষই হই না কেন, সেটাকে অবশ্যই প্রথমে যাচাই করা উচিত, তারপর সত্য হলে গ্রহণ করা উচিত, নাহলে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।

আচ্ছা, এবার নিজেকে চ্যালেঞ্জ করি। কেননা, একজন প্রকৃত দার্শনিক নিজেই নিজেকে বারবার চ্যালেঞ্জ করে, এবং এভাবে করে যুক্তির ফাঁকফোঁকর আবিষ্কার করে শুদ্ধতর যুক্তির দিকে এগিয়ে যায়, এবং শেষমেষ খাঁটি সত্য খুঁজে পায়। আমরাও সেভাবে দার্শনিক স্রষ্টাভাবনায় নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছি। এবারও করব।

চ্যালেঞ্জ: কিন্তু এটা তো বলেনি যে: “বাপ-দাদার ধর্মটা ইসলাম হলে সেক্ষেত্রে ইসলামকেও যাচাই করতে হবে আগে?”

উত্তর: কিন্তু এটাও তো বলেনি যে, ইসলামকে যাচাই করা যাবে না, চোখ বুঁজে অন্ধভাবে মেনে নিতে হবে?

কুরআন কি যুক্তিবাদী? | দার্শনিকের কুরআন যাত্রা




প্রমাণবিহীন বক্তব্যের কোনো মূল্য নেই


قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (١١١)

“... বলুন, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো, তবে তোমাদের প্রমাণ নিয়ে আসো।” (সূরা বাকারা, ২:১১১)


أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آلِهَةً قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ

“তারা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য গ্রহণ করেছে? বলুন, তোমরা তোমাদের প্রমাণ আনো।… ” (সূরা আম্বিয়া, ২১:২৩)

তার মানে কী দাঁড়ালো? আপনি যদি কোনো স্রষ্টার (উপাস্য) কথা বলেন, তাহলে সেটার প্রমাণ আপনাকেই আনতে হবে। যুক্তিবিদ্যায় এটাকে বলা হয় বার্ডেন অব প্রুফ (burden of proof) অর্থাৎ, প্রমাণের দায়ভার। আপনার কথা প্রমাণের দায়িত্ব আপনারই। এটাই যুক্তিশাস্ত্রের কথা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কুরআন যথেষ্ট যুক্তিবাদী বটে! উপরের আয়াত দুটিতে যেন সরাসরি বিতর্কের মঞ্চে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে!

প্রশ্ন: “হুম, সেটাতো করবেই। অন্যদেরকে বলবে প্রমাণ আনো, কিন্তু নিজের বেলায় প্রমাণ দেবে না, তখন শুধু বলবে আল্লাহকে মানো, নাহলে অনন্তকাল আগুনে পোড়ার ভয় দেখাবে।”

প্রিয় পাঠক!

চ্যালেঞ্জ করবেন ঠিক আছে, কিন্তু চ্যালেঞ্জের বক্তব্য যেন আবার পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে না যায়, সেদিকে দয়া করে লক্ষ্য রাখবেন। হ্যাঁ, কুরআন অন্যদেরকে তাদের দাবীকৃত স্রষ্টার প্রমাণ আনতে বলেছে। আসুন এবার দেখি, কুরআন কি শুধু অন্যদেরকে চ্যালেঞ্জ করেই খালাস, নাকি নিজের পক্ষেও যুক্তি দেয়? আল্লাহ নিজের পক্ষে কোনো যুক্তি দিয়েছেন কি কুরআনে? কুরআনে পরম স্রষ্টার ধারণা কীরকম?

কুরআনে পরম স্রষ্টার ধারণা


أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمُ الْخَالِقُونَ (٣٥)


“তারা কি কোনোকিছু (কোনো সৃষ্টি-উৎস/ সৃষ্টিকর্তা) ছাড়াই (নিজে নিজেই/ শূন্য থেকেই) সৃষ্ট হয়েছে, নাকি তারা (নিজেরাই নিজেদের) সৃষ্টিকর্তা?” (সূরা তূর, ৫২:৩৫)


“মানুষ কি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে?” এমন অকাট্য যুক্তি শুনলে স্তম্ভিত হয়ে যেতে হয়! কারণ, আপনি কিভাবে নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করবেন? আপনার সৃষ্টির আগেতো আপনার অস্তিত্বই ছিল না, তাহলে আপনি নিজে কিভাবে নিজেকে সৃষ্টি করবেন!


অতএব, যার সৃষ্টি আছে, সে কখনো নিজে নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে না। সে তার অস্তিত্বমান হবার জন্য (অর্থাৎ সৃষ্টি হবার জন্য) অন্য কোনো উৎসের উপর নির্ভরশীল। আর সেই উৎসই হলেন মহান আল্লাহ তায়ালা। কী অকাট্য যুক্তি!

[বি.দ্র.: দর্শনে এই বিষয়টা আলোচিত হয় “অস্তিত্বের শ্রেণীবিভাগ” শিরোনামে, এবং সকল অস্তিত্বকে দুইভাগে ভাগ করা হয়: ১. অপরিহার্য অস্তিত্ব (essential existence), ২. সম্ভব অস্তিত্ব (possible existence). আলোচনা সংক্ষিপ্ত রাখার স্বার্থে এ বিষয়ে এখানে আলোকপাত করা গেল না।] [QR - দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্তিত্বের শ্রেণীবিভাগ]



একাধিক স্রষ্টা প্রসঙ্গে কুরআন

একাধিক স্রষ্টা থাকলে কী ঘটতো?


وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَهٍ إِذًا لَذَهَبَ كُلُّ إِلَهٍ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلا بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ

“তাঁর (আল্লাহর) সাথে যদি একাধিক উপাস্য থাকত তাহলে প্রত্যেক উপাস্যই নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে চলে যেত এবং তাদের কতক অপর কতককে পরাভূত করত… ” (সূরা মুমিনুন, ২৩:৯১)

সত্যিইতো। চিন্তা করেন, যদি পানির স্রষ্টা বলত, আমি আমার পানি নিয়ে গেলাম। তাহলে জীবজগতের স্রষ্টা কী করত? তার সৃষ্টিকে বাঁচানোর জন্য পানির স্রষ্টার উপর চড়াও হত! এভাবে গোটা সৃষ্টিজগতই ধ্বংস হয়ে যেত, ধ্বংস হয়ে যেত যত স্রষ্টা! সেকথাই দেখুন আরেক আয়াতে আল্লাহপাক বলছেন:


لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ (٢٢)


“যদি এতদুভয়ে (আসমান ও জমিনে) আল্লাহ ব্যতীত আরো একাধিক ইলাহ থাকত, তাহলে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত…” (সূরা আম্বিয়া, ২১:২২) ।

কারণ এক রাজত্বে দুই রাজা থাকতে পারে না কখনো। একই দাসের দুই মালিক হয় না। তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব যে, মহাবিশ্বের একাধিক পরম স্রষ্টা থাকবে?

এছাড়াও, একাধিক স্রষ্টা পেতে হলেতো আরেক স্রষ্টার সৃষ্টি হতে হবে। কিন্তু “পরম স্রষ্টা” মানেই হলো তিনি সৃষ্টিপ্রক্রিয়া থেকে মুক্ত। অতএব, এটা কিভাবে সম্ভব যে, পরম স্রষ্টা কাউকে জন্ম দেবেন, আর একজন দ্বিতীয় স্রষ্টা পাওয়া যাবে? আল্লাহপাক সূরা ইখলাসে বলেছেন:


لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ (٣)

“তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি।” (সূরা ইখলাস, ১১২: ৩)

আমাদের দীর্ঘ দার্শনিক স্রষ্টাভাবনার ফলাফল কুরআন চারটি বাক্যের একটি ছোট্ট সূরায় কত সুন্দর করেই না গুছিয়ে দিয়েছে!

কুরআনে ত্রিত্ববাদ নাকচ করা হয়েছে

আমরা জানি যে, অধিকাংশ খ্রিষ্টান ঈসা (আ.)-কে স্রষ্টার পুত্র বলে থাকে। এ ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেন:


وَلا تَقُولُوا ثَلاثَةٌ انْتَهُوا خَيْرًا لَكُمْ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ

“আর তোমরা বলো না যে, (ঐশী সত্তা) তিনজন (আল্লাহ তাঁদের মধ্যে একজন); (একথা বলা হতে) বিরত থাক, (বিরত থাকলে তা হবে) তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। নিঃসন্দেহে আল্লাহ একক উপাস্য। তাঁর পুত্র থাকবে – এ থেকে তিনি পরম প্রমুক্ত।” (সূরা নিসা, ৪:১৭১)

এখানে ‘সুবহান’ (পরম প্রমুক্ত) শব্দটা দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যে, তিনি সন্তান জন্ম দেয়ার সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। আর এই জন্মগ্রহণ বিষয়টা যে পরম স্রষ্টার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না, সে যুক্তি আমরা “ব্যাকট্র্যাকিং” পর্বে ও “একাধিক স্রষ্টার” আলোচনায় বলেছিলাম।

পাঠক! এটা কত বড় স্পর্ধা যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, সেই পরম প্রভুর নামে শারীরিকতার অপবাদ দেব! যিনি আমার জন্ম, মায়ের আদরে বেড়ে ওঠা, খাদ্য, পানীয়, বাসস্থান – সবকিছুর ব্যবস্থা করেছেন, প্রকৃতিতে নিয়োজিত করেছেন আমার খেদমতে, সেই পরম স্রষ্টার ব্যাপারে “খোদার পুত্র আছে” বলাটা ভয়ানক স্পর্ধা ছাড়া আর কী?


يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلا الْحَقَّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ

“হে আহলে কিতাব! তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কোরো না এবং আল্লাহর সম্পর্কে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বোলো না। নিঃসন্দেহে মরিয়মের পুত্র ঈসা মসীহ আল্লাহর রাসুল… “ (সূরা নিসা, ৪:১৭১)

পুনরুত্থান দিবসের যুক্তি

পুনরুত্থান দিবস কী? কুরআন বলছে যে, সকল মানুষের মাঝে পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার সম্পন্ন করা হবে, এমন একটি দিনই হলো পুনরুত্থান দিবস। সেইদিন পৃথিবীর সকল মানুষকে কবর থেকে তোলা হবে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, মাটির মাথে মিশে যাওয়া দেহ, কিংবা বাঘের পেটে চলে যাওয়া দেহ কিভাবে আবার সব এসে জোড়া লেগে আগের মানুষটা হবে? আমরাতো কখনো এমনটা হতে দেখি নাই। এমন প্রশ্ন মনে আসাটাই স্বাভাবিক! দেখুন, সেটার পক্ষেও আল্লাহ তায়ালা যুক্তি দিচ্ছেন:


قَالَ مَنْ يُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ (٧٨) قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنْشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ (٧٩)

“…সে (অর্থাৎ পরকাল অস্বীকারকারী ব্যক্তি) বলে: ‘পচে-গলে যাওয়া হাড়গুলোকে কে জীবিত করবে?’ (হে রাসূল!) বলুন, তিনিই তাকে (অর্থাৎ পচে-গলে যাওয়া অস্থিগুলোকে) জীবিত করবেন যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন; আর তিনি সকল সৃষ্টি সম্পর্কে চিরজ্ঞানী।” (সূরা ইয়া-সীন, ৩৬:৭৮-৭৯)

কী চমৎকার যুক্তি! চিন্তা করে দেখুন, প্রথমবার সৃষ্টি করা কি বেশি কঠিন, নাকি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা বেশি কঠিন? যিনি প্রথমবার মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সেই পরম স্রষ্টার পক্ষে কি এটা মোটেও কঠিন যে, মাটিতে মিশে যাওয়া মানুষকে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করবেন? প্রথমবার সৃষ্টি করা বেশি কঠিন, নাকি দ্বিতীয়বার?

নিশ্চয়ই প্রথমবার সৃষ্টি করা বেশি কঠিন!

কুরআন আল্লাহর বাণী হওয়ার পক্ষে যুক্তি


أَفَلا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللَّهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلافًا كَثِيرًا (٨٢)

“তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না? এটি যদি আল্লাহর নিকট ব্যতীত অন্য কারো থেকে এসে থাকত তাহলে অবশ্যই তারা এতে অনেক স্ববিরোধিতা পেত।” (সূরা নিসা, ৪:৮২)

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন: “কুরআন যে আল্লাহর বাণী, তার প্রমাণ কী?” উত্তরে আল্লাহ বলছেন যে, এই কুরআনই তার প্রমাণ।

কিন্তু কিভাবে? এইভাবে যে, এই কুরআনে কোনো পরস্পরবিরোধিতা নাই। কোনো ভুল নাই। কেননা, ভুল করা, পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেওয়া, এগুলো মানুষের কাজ। কারণ তার নানারকম সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সকল সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। অতএব, না তাঁর কোনো কমতি আছে যে তিনি ভুল করবেন, আর না তিনি ইচ্ছা করে ভুল বলবেন। অতএব, কেউ যদি গোটা কুরআন নিরপেক্ষ মনে বারবার পড়ে, তবে সে এটাতে কোনো পরস্পবিরোধিতা খুঁজে পাবে না। অতএব –

প্রশ্ন: কুরআন যে আল্লাহর বাণী, এর প্রমাণ দিন?

উত্তর: কুরআনই এর প্রমাণ।

প্রশ্ন: সেই কুরআনটাই যে আল্লাহর বাণী, সেটা প্রমাণ করেন?

উত্তর: কুরআন।

কুরআনকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করলেই প্রমাণ হয়ে যায় যে, কুরআন আল্লাহর বাণী। পরম স্রষ্টার অস্তিত্বের সপক্ষে যুক্তি, তাঁর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যুক্তি, ইত্যাদি কুরআনের ভিতরেই আছে, যা পড়লে একজন মানুষ এই গ্রন্থকে স্রষ্টার বাণী হিসেবে চিনে নিতে পারে। এবং বুঝতে পারে যে, এটাই সত্য। অতএব, যুক্তি হিসেবে কুরআন নিজেই নিজের প্রমাণ। তার প্রমাণের জন্য অন্য কারো উপর নির্ভর করতে হয় না। গোটা কুরআন একত্রে একটি একক প্রমাণ হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থিত হয়।

কুরআনের সংরক্ষণশীলতা


إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ (٩)

“নিঃসন্দেহে আমিই (আল্লাহ) এ যিকর (স্মরকগ্রন্থ/ কুরআন) নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক।” (সূরা হিজর, ১৫:৯)

প্রশ্ন আসতে পারে, কিভাবে কুরআন সংরক্ষিত আছে?

উত্তরে বলা যায়: কুরআন বিকৃতির কোনো এভিডেন্স কি দিতে পারবেন?

প্রশ্ন: বিকৃতির প্রমাণ আমি দেব কেন? সংরক্ষণশীলতার দাবী আপনি করছেন, প্রমাণ আপনি দিন! যে দাবী করে, তাকেই প্রমাণ দিতে হয়। বার্ডেন অব প্রুফ - আপনিইতো বলেছিলেন, মনে নেই!

উত্তর: তা ঠিক। মেনে নিলাম। কুরআনকে অবশ্যই আল্লাহপাক সংরক্ষিত করেছেন। কতভাবে সংরক্ষণ করেছেন, তার সবটা আমি জানি না, তবে একটি জিনিস জানি, আর তা হলো:
কুরআনই পৃথিবীর একমাত্র ধর্মগ্রন্থ, যা সংরক্ষিত আছে অ-ধ্বংসশীল মানব-মস্তিষ্কে। পৃথিবীর সকল কাগজের কুরআন আপনি ধ্বংস করে দিতে পারেন, ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আধুনিক সভ্যতার যত কম্পিউটার এবং সকল লেখার জিনিস, কিন্তু পৃথিবীতে যতদিন মানুষ আছে, ততদিন কুরআন আছে মানব মস্তিষ্কে। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম থেকেই মুসলমানদের মাঝে গোটা কুরআন মুখস্থ করার রীতি চালু আছে। মুখস্থ করার সাপেক্ষে এটা একটা বড় গ্রন্থই বটে! কিন্তু কী বিস্ময়করভাবে গোটা কুরআন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শতভাগ নির্ভুলভাবে মুখস্থ করে রেখেছে কত লাখো কোটি মুসলমান! বিশ্বাস না হলে মিলিয়ে দেখুন!

পাঠক! তারপরও কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। কুরআনও আল্লাহর কিতাব, তাওরাত ও ইঞ্জিলও আল্লাহর কিতাব। কিন্তু তাহলে ওগুলোকে কেন তিনি সংরক্ষণ করেননি? খ্রিষ্টানরা ওগুলি বিকৃত করতে সক্ষম হলো কিভাবে? স্রষ্টার গ্রন্থ যদি বিকৃতই করা যায়, তাহলে সেটা কি স্রষ্টার purpose বা উদ্দেশ্যকে ব্যহত করে না?

আসুন দেখি তাহলে কুরআন এ ব্যাপারে কী বলছে।

১. মূসা (আ.) এর উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব তাওরাত

২. ঈসা (আ.) এর উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাব ঈঞ্জিল

৩. এই দুটি কিতাব একত্রে বাইবেল নামক গ্রন্থে স্থান পেয়েছে, যা ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মাঝে প্রচলিত।

এবং এটা সুবিদিত যে, বর্তমানে বাইবেলের বিভিন্ন ভার্সন আছে, এবং এর একটার সাথে আরেকটার গরমিল আছে। অর্থাৎ, বিকৃতি ঘটেছে। তাহলে কি আল্লাহ তাঁর নিজের গ্রন্থকে মানুষের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি বলেই আরেকটা নতুন গ্রন্থ “কুরআন” পাঠিয়েছেন? এর উত্তর আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সূরা বাকারায় দিয়েছেন এইভাবে:

مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا

“আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা ভুলিয়ে দিলে তারচেয়ে উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের (আয়াত) আনয়ন করি। …” (সূরা বাকারা, ২:১০৬)

অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে এযাবৎ যত ঐশী বাণী পাঠিয়েছেন, তাঁর সবই সংরক্ষণ করেছেন। এমনকি তাওরাত কিংবা ইঞ্জিলও এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত আছে, তবে তার বিধানগুলি অপরিবর্তিত কিংবা উন্নত আকারে কুরআন নামক গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়ে গিয়েছ, এবং এভাবেই সেগুলি সংরক্ষিত আছে।

ইসলামের যুদ্ধনীতি মুসলমানদের বিপক্ষে?!

আল্লাহপাক তো চাইলেই কুরআনকে “১০১টি মূলনীতি” এরকম একটা বইয়ের রূপ দিতে পারতেন। যেখানে ১,২,৩… এভাবে করে বিভিন্ন আইন দেয়া থাকবে শুধু। আর মুসলমান হলেই সেগুলো সব মেনে চলতে হবে, কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। কিন্তু দেখুন, যেখানে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সেখানেই আল্লাহপাক যুক্তি দিয়ে দিয়েছেন। যেমন দেখুন, ইসলামের যুদ্ধনীতির একটি নিয়ম হলো (সূরা তওবা, ৯:৬ অনুযায়ী):
অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যদি শত্রুপক্ষের কেউ যেকোনো মুহুর্তে বলে: “আমি নিরাপত্তা চাই” এবং অস্ত্র সমর্পন করে, তখন তাকে –

১. হত্যা করা যাবে না,

২. তাকে শত্রুপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে,

৩. তাকে নিরাপত্তা দিয়ে রাখতে হবে নিজেদের কাছে,

৪. তারপর সে যেদিন চাইবে, সেদিন তাকে নিরাপত্তা দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।

পাঠক! একটু চিন্তা করে দেখুন। যুদ্ধের নিয়মানুযায়ী মুসলমানরা যখন এই শর্তগুলো শত্রুপক্ষকে জানাবে, তখন তারা যদি এটার সুযোগ নেয়? হেরে যেতে বসলেই যদি হঠাৎ অস্ত্র ফেলে দিয়ে বলে: “আমি নিরাপত্তা চাই।” তখন তাকে তো হত্যা করা যাবেই না, উল্টা প্রেসিডেন্টের মত সিকিউরিটি দিয়ে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিতে হবে তাকে!

দুনিয়ার কোনো মানুষ এমন শর্তে যুদ্ধ করতে রাজি হবে? কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে এমনই শর্ত দিয়ে দিচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে প্রশ্ন আসবে, এটাতো যুদ্ধ শুরু আগেই মুসলমানদেরকে হারিয়ে দেওয়ার মত! নাস্তিক-কাফির-মুশরিকদেরকে বেশি সুবিধা দেওয়া! এটাতো মুসলমানদের প্রতি অবিচার! তারমানে কি ইসলামের যুদ্ধনীতি মুসলমানদেরই বিপক্ষে?

তখন দেখুন আল্লাহপাক এই যুদ্ধনীতির পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন একই আয়াতে:

فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلامَ اللَّهِ

“তাকে আশ্রয় দেবে যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়।” (সূরা তওবা, ৯:৬)

অর্থাৎ, কোনো মানুষের কাছে কুরআনের বাণী পৌঁছে দেয়াটা একজন মুসলিমের কাছে যুদ্ধে জেতার চেয়েও বড় সাফল্য। যারা যুদ্ধের ময়দানে মুসলিমদের হত্যা করতে এসেছে, তারাও তো আল্লাহরই বান্দা! যদিও অবাধ্য বান্দা, তবুও, আল্লাহরই তো! আর রহমান রহীম আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা এই যে, মুসলমানের হাত ধরে ইসলামের শত্রুরা কুরআন শ্রবণ করুক, কুরআনের অকাট্য সব যুক্তি ও দর্শন তার অন্ধ বিশ্বাসে আঘাত করুক, এবং তাকে নিয়ে যাক আলোর দিকে।


الر كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ

“আলিফ লা-ম রা; এটি একটি গ্রন্থ, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি – যাতে আপনি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন …।” (সূরা ইবরাহীম, ১৪:১)

মুহাম্মদ (সা.) এর সত্যবাদিতার পক্ষে যুক্তি

قُلْ لَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا تَلَوْتُهُ عَلَيْكُمْ وَلا أَدْرَاكُمْ بِهِ فَقَدْ لَبِثْتُ فِيكُمْ عُمُرًا مِنْ قَبْلِهِ أَفَلا تَعْقِلُونَ (١٦)

“(হে রাসূল! তাদেরকে) বলে দিন: আল্লাহ্ যদি চাইতেন (যে, আমাকে নবুওয়াতের দায়িত্ব দেবেন না) তাহলে আমি তোমাদের নিকট তা (অর্থাৎ কুরআন) পাঠ করতাম না এবং তিনি তোমাদেরকে (এ বিষয়ে) অবহিত করতেন না; এর আগে থেকেই তো আমি আমার জীবন তোমাদের মধ্যেই কাটিয়েছি; অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে না?” (সূরা ইউনুস, ১০:১৬)

পাঠক, যুক্তির অংশটা লক্ষ্য করুন। জীবনের চল্লিশটা বছর মুহাম্মদ (সা.) আরবের এই লোকদের মাঝেই কাটিয়েছেন। তারা সকলেই দেখেছে মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন যাপন, আচরণ, আমানতদারিতা। তারাই নাম দিয়েছে আল আমিন (বিশ্বস্ত)। এবং এই চল্লিশটা বছরে কোনো একটা মানুষও কখনো তাকে মিথ্যাবাদী বলেনি। তাইতো আল্লাহপাক যুক্তি দিচ্ছেন যে, মুহাম্মদের (সা.) গোটা জীবন তো তোমাদের চোখের সামনেই আছে, দেখো মাইক্রোস্কোপের নিচে নিয়ে! খুঁজে দেখো ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার লোভ, নারীর লোভ ইত্যাদির লেশমাত্র পাও কিনা তার মাঝে! তার চরিত্রকে দোষারোপ করার মত বিন্দুমাত্র কিছু পাও কিনা, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখ! এবং তোমরা সেটা দেখেছোও বটে। আর সেজন্যেই তার নাম দিয়েছো আল আমিন। তার কাছে নিজেদের আমানত রেখেছ, বিভিন্ন বিষয়ে তার দেয়া সমাধানকে সর্বোত্তম হিসেবে মেনে নিয়েছ। আর আজকে যখন সেই মানুষটাই এক আল্লাহর দিকে আহবান করছে, তখন তাকে মিথ্যাবাদী বলছ? বরং তোমাদের নিজেদেরকে মিথ্যাবাদী বলো!

এত যুক্তি সত্ত্বেও যারা সত্যকে অস্বীকার করে


وَمَثَلُ الَّذِينَ كَفَرُوا كَمَثَلِ الَّذِي يَنْعِقُ بِمَا لا يَسْمَعُ إِلا دُعَاءً وَنِدَاءً صُمٌّ بُكْمٌ عُمْيٌ فَهُمْ لا يَعْقِلُونَ (١٧١)


আর যারা কাফের হয়েছে (অর্থাৎ সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে) তাদের উপমা হচ্ছে তার ন্যায় যাকে ডাকা হলে সে হাঁকডাক ছাড়া আর কিছুই শুনতে পায় না (অর্থ বুঝতে পারে না); তারা বধির, বোবা ও অন্ধ, সুতরাং তারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না।” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৭১)

দেখুন, প্রথমে আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে তোমরা যার উপাসনা করো, তার পক্ষে যুক্তি আনো। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন যে: ১. অবশ্যই সৃষ্টির একজন স্রষ্টা/উৎস থাকতে হবে, এবং ২. একাধিক পরম স্রষ্টা থাকা সম্ভব না। এছাড়াও, পুনরুত্থান দিবস কিংবা যুদ্ধনীতিগুলোর সপক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছেন। যুক্তি দেখাচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সত্যবাদিতার সপক্ষে। এরপরও কিছু লোক যুক্তি মানে না, বাপ-দাদার ধর্মকে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে। আর এই কাজটাকেই আল্লাহ তায়ালা বলছেন কুফুরি, অর্থাৎ যুক্তিকে (সত্যকে) প্রত্যাখ্যান। আর যারা যুক্তি ব্যবহার করে না, তারাই আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে বধির, বোবা ও অন্ধ।

এখন, প্রিয় পাঠক! উপরের কথাটি আপনি যদি একজন মুসলিমকে বলেন, তাহলে কী প্রতিক্রিয়া পাবেন আমি জানি না। তবে খুব যে ভালো কোনো প্রতিক্রিয়া পাবেন, সে ভরসা আমি পাই না। কেননা বহু মুসলিমের মুখে আমি একথা শুনেছি যে, “কুরআনে যুক্তি প্রয়োগ করা চলবে না, ধর্ম যুক্তির বিষয় না, এটা বিশ্বাসের ব্যাপার”, ইত্যাদি। তাদেরকে বলে দিন যে, যদি তারা যুক্তিবিরোধী মানুষ হয়, তবে আল্লাহর দৃষ্টিতে তারা বধির, বোবা ও অন্ধ। আর এতেও যদি তারা যুক্তি ব্যবহারকে মেনে না নেয়, তবে তাদের জন্য যুক্তির এই মহাগ্রন্থ কুরআনে অপেক্ষা করছে আরো ভয়ানক কথা।

বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ না করলে ঈমানই অর্জন হবে না


وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تُؤْمِنَ إِلا بِإِذْنِ اللَّهِ وَيَجْعَلُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لا يَعْقِلُونَ (١٠٠)


“আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কেউ ঈমান (অর্থাৎ পরকালীন জীবনে সুরক্ষা) অর্জন করতে পারে না। আর যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে না তিনি (আল্লাহ) তাদেরকে কলুষলিপ্ত করে রাখেন (ফলে তারা ঈমানের সুযোগ পায় না)।” (সূরা ইউনুস, ১০:১০০)

আরবিতে বলে আক্বল (যেটা থেকে বাংলা শব্দ আক্কেল হয়েছে)। আক্বল অর্থ বিচারবুদ্ধি তথা কোনো কিছু যুক্তি দিয়ে যাচাই বাছাই করার ক্ষমতা। বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করা মানে সোজা বাংলায় বুদ্ধি খাটানো। তো, যারা আক্বল ব্যবহার করে না, আল্লাহপাক তাদেরকে শাস্তিস্বরূপ কলুষিত করে রাখেন। তাদেরকে ঈমান অর্জনের অনুমতি দেন না। ফলে তারা ঈমান অর্জন করতে পারে না।

চিন্তা করে দেখেছেন! যুক্তি, বিচারবুদ্ধি, আক্বল – যা-ই বলুন না কেন, এটাই হলো ঈমানের দরজা। আপনি যদি যুক্তিবাদী না হন এবং ইসলামকে “বিশ্বাসের বিষয়” বানিয়ে যুক্তিকে বর্জন করেন, তাহলে আল্লাহর দৃষ্টিতে তো আপনি বধির-বোবা-অন্ধ হবেনই, উপরন্তু শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ আপনাকে ঈমানই অর্জন করতে দেবেন না।

প্রশ্ন: “কিন্তু ঈমান অর্থই তো বিশ্বাস! আর বিশ্বাসের মধ্যে যুক্তি চলে না। কিন্তু আপনি বলছেন যে যুক্তি ছাড়া ঈমান অর্জন হয় না?”

প্রিয় পাঠক, এ প্রসঙ্গে স্বতন্ত্র্য আলোচনা করার প্রয়োজন অনুভব করছি।

_______________________________

বাপ-দাদার দেখাদেখি ধর্ম পালনের কোনো মূল্য নেই।

বিশ্বাস নয়, বরং বিচারবুদ্ধি প্রয়োগই ঈমানের দরজা।

আপনি কী ভাবছেন? আমাদের সাথে শেয়ার করতে মোবাইলে কোডটি স্ক্যান করুন।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক জনপ্রিয়

স্রষ্টাভাবনা

প্রথম ভাগ: দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা  | | পর্ব-১: উৎসের সন্ধানে উৎসের সন্ধান করা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। মানুষ তার আশেপাশের জিনিসের উৎস জানতে চায়। কোথাও পিঁপড়ার লাইন দেখলে সেই লাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে পিঁপড়ার বাসা খুঁজে বের করে। নাকে সুঘ্রাণ ভেসে এলে তার উৎস খোঁজে। অপরিচিত কোনো উদ্ভিদ, প্রাণী কিংবা যেকোনো অচেনা জিনিস দেখলে চিন্তা করে – কোথা থেকে এলো? কোথাও কোনো সুন্দর আর্টওয়ার্ক দেখলে অচেনা শিল্পীর প্রশংসা করে। আকাশের বজ্রপাত, বৃষ্টি, রংধনু কিংবা সাগরতলের অচেনা জগৎ নিয়েও মানুষ চিন্তা করে। এমনকি ছোট শিশু, যে হয়তো কথাই বলতে শেখেনি, সে-ও কোনো শব্দ শুনলে তার উৎসের দিকে মাথা ঘুরায়। অর্থাৎ, মানুষ জন্মগতভাবেই কৌতুহলপ্রবণ। একটা বাচ্চা জ্ঞান হবার পর চিন্তা করে – আমি কোথা থেকে এলাম? আরো বড় হবার পর চিন্তা করে – আমার মা কোথা থেকে এলো? এমনি করে একসময় ভাবে, পৃথিবীর প্রথম মা ও প্রথম বাবা, অর্থাৎ আদি পিতা-মাতা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল? চারিদিকের গাছপালা, প্রকৃতি, পশুপাখি, গ্রহ-নক্ষত্র-মহাবিশ্ব – এগুলিরই বা সৃষ্টি হয়েছে কিভাবে? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন উৎসুক মনে খেলে যায়। তখনই শুরু হয় সমস্যা। নির

খোদার ন্যায়বিচার | অনন্তের পথে

আগের পর্ব: আল্লাহ কেন পথভ্রষ্ট করেন? | সূচীপত্র দেখুন প্রশ্ন: এমনও অনেকে আছে, যারা ইসলামের নামও শোনেনি, যাদের কাছে কুরআন পৌঁছায় নাই, তাদের কী হবে? তারা কেন জাহান্নামে যাবে? তাদের কী দোষ? কোথায় খোদার ন্যায়বিচার? নাস্তিকদের একটা কমন প্রশ্ন এটা। এবং প্রশ্নটা অবশ্যই অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মুসলমানই ইসলামকে যৌক্তিক ও দার্শনিক মানদণ্ডে যাচাই করে তারপর সত্য হিসেবে গ্রহণ করে মানে না, বরং তারা মানে বাপ-দাদার ধর্ম হিসেবে, (অন্ধ)বিশ্বাসের বস্তু হিসেবে। আর তাই এসকল প্রশ্নের যৌক্তিক সত্য জবাবও তারা দিতে পারেন না। দেবেনই বা কিভাবে, নিজেই তো জানেন না! উপরন্তু নিজের (অন্ধ)বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার জন্য গোঁজামিলে পরিপূর্ণ ভুলভাল ব্যাখ্যা হাজির করেন। তাই তারা বলেন, “মুসলমান না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না। অমুসলিম মাত্রেই জাহান্নামী”, ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ একটা পতিতালয়ে যে মেয়েটির জন্ম হয়, সে মেয়েটি কী দোষ করেছিল তাহলে? ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এমন সব প্রশ্নকে দূরে ঠেলে “মুসলিম না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না ব্যস” বলে বসেন। অথচ জন্ম ও বেড়ে ওঠার উপর কারো হাত নেই। দুনিয়ার প্রতিটা মানুষই ভিন্ন ভ

আত্মদর্শন | অনন্তের পথে

আগের পর্ব: জ্ঞানের জগত ও হৃদয়ের জগত | সূচীপত্র দেখুন আমি কে? “I am not this hair, not this skin But the soul that lies within.” - Maulana Rumi আমি কে - এই প্রশ্ন যুগে যুগে দার্শনিকদেরকে চিন্তিত করেছে। অনেকে বলেছে, মানব মস্তিষ্কেই কেবল আমিত্বের অনুভূতি বিদ্যমান। কথা হয়ত সত্য। তবে যেহেতু তারা ক্বলবের জগত সম্পর্কে বেখবর, তাই তারা তাদের সীমিত জ্ঞানবৃত্তের ভিতরেই উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে। মানুষের আত্মা হলো আসল খলিফা وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ (١٧٢) أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ (١٧٣) “আর (হে রাসূল!) যখন আপনার রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বহির্গত করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং তাদের নিজের ওপর তাদেরকে সাক্ষ্য করলেন; (তাদেরকে প্রশ্ন করলেন,) আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল, অবশ্যই, আ