সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভুল প্রশ্ন | দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা



আমরা অনেকসময় ভুল প্রশ্ন করে বসি। যেমন, “গতকাল তো স্রষ্টা বেঁচে ছিল, আজও কি বেঁচে আছে?” কিংবা: “মানব সৃষ্টির আগে তো পরম স্রষ্টা বেঁচে ছিল, কিন্তু আজও কি বেঁচে আছে?” এগুলো সবই ভুল প্রশ্ন। কেন? সেটা আমরা আগের পর্ব “ইনফিনিটিতে বসবাস”-এ আলোচনা করেছি। কারণ, স্রষ্টা তো সময়ের ডাইমেনশানে বসবাস করেন না। তিনি তো সময়ের ঊর্ধ্বে (beyond the limitations of time)। তাই তাঁর সাথে সময়কে জড়িয়ে প্রশ্ন করা যায় না। এগুলো দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে “ভুল প্রশ্ন” ক্যাটেগরিতে পড়ে।

যেমন, আপনি যদি প্রশ্ন করেন, “ভাই, আপনার পোষা বিড়ালটি কি ব্যাটিং ভালো পারে, নাকি বোলিং ভালো পারে?” এটা একটা “ভুল প্রশ্ন”। কেন? কারণ ক্রিকেট খেলাই তো বিড়ালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না, তার আবার ব্যাটিং-বোলিং কী!

কিন্তু তাহলে কেন মানুষ যুগযুগ ধরে ভুল প্রশ্ন করে আসছে স্রষ্টার ব্যাপারে?

ঐযে, প্রভাবিত মন! আগেই তো তাকে ধর্মের ব্রেইনওয়াশিং দিয়ে দেওয়া হয়েছে! কিংবা দেওয়া হয়েছে নাস্তিকতার ব্রেইনওয়াশিং। কিংবা হয়ত নাস্তিকের যুক্তিখণ্ডন করতে দৌড়ে গিয়ে ধর্মগুরুর কাছ থেকে দুইটা কথা শিখে এসে মুখস্থ আউড়িয়েছে: কখনোতো নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত মুক্ত মনে নিজে নিজে সত্যের সন্ধান করেনি। অপরদিকে নাস্তিকও হয়ত একইভাবে নাস্তিক-গুরুর বই থেকে দুইলাইন পড়ে এসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। এমনি করে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কের রেসলিং খেলা চলে আসছে যুগযুগ ধরে। নিছক সত্য জানার জন্যে কয়জন চেষ্টা করে? বেশিরভাগ মানুষই তার বাপ-দাদার ধর্মকে ১০০% সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা চালায়। একই অবস্থা নাস্তিকদেরও। কারোরই সত্য জানার আগ্রহ নেই। বরং কেবল নিজ দলকে গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা, আর সেজন্যে যত ভুল প্রশ্ন, ভুল যুক্তি আর অপযুক্তির অবতারণা করা।

কিন্তু পাঠক! আপনিতো আর সে ভুল করবেন না। আপনি একজন প্রকৃত মুক্তমনার মত নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত মনে পরম স্রষ্টার ধ্যান করবেন। স্রষ্টাভাবনায় তাই আপনাকে আরো একবার স্বাগতম।

পাঠক! আশা করি ইতিমধ্যে আপনি নিজেকে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন, এবং ইনফিনিটির ধারণাকে আত্মস্থ করেছেন। আর যদি তা না করে থাকেন, তবে “ইনফিনিটিতে বসবাস” পর্বটি আরেকবার পড়ে দুই দশদিন আপনমনে ভাবনা করে তারপর আবার এখানে আসার অনুরোধ রইলো।

এবার আমরা আরো দু-একটি উদাহরণ দেব।

মনে করেন, একটা বিশাল ফুটবল খেলার মাঠ। তাতে চক দিয়ে একটা বিশাল সার্কেল তথা বৃত্ত আঁকলাম। তার কেন্দ্রে বসালাম পরম স্রষ্টাকে। তারপর ঐ সার্কেল জুড়ে রেললাইন বসালাম। সেই বৃত্তীয় রেললাইনের একটা পয়েন্টে পতাকা লাগালাম: শুরু - start. তারপর পুরো বৃত্ত ঘুরে ঐ পতাকার একটু পিছনে আরেকটা পতাকা লাগালাম: শেষ - end. এবার খেলা শুরু!
ভুল প্রশ্ন | দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা




স্টার্ট পয়েন্টের ঠিক সামনেই একটা মানুষকে দাঁড় করিয়ে দিলাম, পায়ের সাথে বেঁধে দিলাম রেলগাড়ির মত চাকা। তারপর– “একটা চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া…।” হুম, আপনার জীবন শুরু হয়ে গেল। সারাক্ষণ আপনাকে চলতে হবে, এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। যেই মুহুর্তে থেমে যাবেন, ঐ মুহুর্তেই মৃত্যু। আর রেললাইনটা হলো সময়। যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন, ততই আপনি “অতীতকে” পিছনে ফেলে আসছেন। আর ততই এগিয়ে যাচ্ছেন “ভবিষ্যত” এর দিকে। আর পরম স্রষ্টা? তিনি কিন্তু সেই মধ্যবিন্দুতেই বসে আছেন!

এখন চলতে চলতে আপনি যদি একদিন প্রশ্ন করেন: “আমিতো রেললাইনের ২ কিলোমিটার পার হয়ে এসেছি (২ বছর বয়স হয়েছে), পরম স্রষ্টা কয় কিলোমিটার পার করেছে (পরম স্রষ্টার বয়স কত বছর হলো)?” কিংবা, আমিতো আগামীকাল রেললাইনের ওমুক জায়গায় থাকবো, স্রষ্টা তখন কোথায় থাকবে?

এগুলো সবই ভুল প্রশ্ন! কারণ আপনিতো সময়ের উপরে আছেন। পক্ষান্তরে পরম স্রষ্টাতো সময়ের সীমায় বন্দী নন, তিনি তো সময়ের ঊর্ধ্বে! ইনফিনিটিতে তাঁর বসবাস! ইনফিনিটি তাঁর সত্তার বৈশিষ্ট্য। ইনফিনিটি ছাড়া তাঁকে চিন্তা করা যায় না। পরম স্রষ্টাই হলেন সত্যিকারের ইনফিনিটি!

অতএব, পরম স্রষ্টার সাথে সময়কে সম্পর্কিত করে প্রশ্ন করা বন্ধ করুন। Stop asking the wrong question. এই বোকামি দুনিয়ার হাজার কোটি মানুষ করেছে, আজও করছে। আপনি অন্ততঃ সেই বোকামি থেকে বেরিয়ে আসুন। প্রকৃত জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করুন।

এবার প্রশ্ন: ঠিক আছে, পরম স্রষ্টার ক্ষেত্রে নাহয় সময় প্রযোজ্য না। মানলাম যে তিনি সময়ের ঊর্ধ্বে - beyond the limitations of time। কিন্তু তিনি কি এখনো বেঁচে আছেন? তাঁর যে ধ্বংস হয়নি, তারই বা প্রমাণ কী?

উত্তর: অন্ততঃ মানুষ যে পরম স্রষ্টা তথা ইনফিনিটিকে হত্যা করতে পারবে না, সেটা তো বোঝা গেল। কারণ আপনার পা তো সেই রেললাইনে বন্দী। সময় আপনার একটি ডাইমেনশান, যা আপনি ত্যাগ করতে পারবেন না। আপনি কি চাইলেই নিজেকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতাহীন করে ফেলতে পারবেন? না। ঠিক একইভাবে আপনি চাইলেই নিজেকে সময়হীন করতে পারবেন না। আপনি চাইলেই সময়ের ঊর্ধ্বে উঠতে পারবেন না। আর সময়ের ঊর্ধ্বে যদি উঠতে না-ই পারেন, তাহলে কিভাবে ইনফিনিটিতে গিয়ে স্রষ্টাকে হত্যা করবেন?

কিন্তু পাঠক, এতেই কি স্রষ্টাভাবনা শেষ হয়? নাহ! আবারো নিজেকেই নিজে চ্যালেঞ্জ করে বসলাম!

প্রশ্ন: তাহলে, ধরেন, (ইনফিনিটির জগতে) আরেকজন পরম স্রষ্টা – সে মানুষের পরম স্রষ্টাকে হত্যা করল?

প্রিয় পাঠক, এই প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদেরকে যেতে হবে পরের পর্বে: একাধিক পরম স্রষ্টা থাকা কি সম্ভব?

_______________________________

“পরম স্রষ্টা সময়ের ঊর্ধ্বে।

তাঁর সাথে সময়কে জড়িয়ে করা প্রতিটি প্রশ্নই ভুল প্রশ্ন।”

এমন কতটি ভুল প্রশ্ন আপনি জানেন? আমাদের সাথে শেয়ার করুন


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক জনপ্রিয়

স্রষ্টাভাবনা

প্রথম ভাগ: দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা  | | পর্ব-১: উৎসের সন্ধানে উৎসের সন্ধান করা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। মানুষ তার আশেপাশের জিনিসের উৎস জানতে চায়। কোথাও পিঁপড়ার লাইন দেখলে সেই লাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে পিঁপড়ার বাসা খুঁজে বের করে। নাকে সুঘ্রাণ ভেসে এলে তার উৎস খোঁজে। অপরিচিত কোনো উদ্ভিদ, প্রাণী কিংবা যেকোনো অচেনা জিনিস দেখলে চিন্তা করে – কোথা থেকে এলো? কোথাও কোনো সুন্দর আর্টওয়ার্ক দেখলে অচেনা শিল্পীর প্রশংসা করে। আকাশের বজ্রপাত, বৃষ্টি, রংধনু কিংবা সাগরতলের অচেনা জগৎ নিয়েও মানুষ চিন্তা করে। এমনকি ছোট শিশু, যে হয়তো কথাই বলতে শেখেনি, সে-ও কোনো শব্দ শুনলে তার উৎসের দিকে মাথা ঘুরায়। অর্থাৎ, মানুষ জন্মগতভাবেই কৌতুহলপ্রবণ। একটা বাচ্চা জ্ঞান হবার পর চিন্তা করে – আমি কোথা থেকে এলাম? আরো বড় হবার পর চিন্তা করে – আমার মা কোথা থেকে এলো? এমনি করে একসময় ভাবে, পৃথিবীর প্রথম মা ও প্রথম বাবা, অর্থাৎ আদি পিতা-মাতা কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল? চারিদিকের গাছপালা, প্রকৃতি, পশুপাখি, গ্রহ-নক্ষত্র-মহাবিশ্ব – এগুলিরই বা সৃষ্টি হয়েছে কিভাবে? ইত্যাদি নানান প্রশ্ন উৎসুক মনে খেলে যায়। তখনই শুরু হয় সমস্যা। নির

খোদার ন্যায়বিচার | অনন্তের পথে

আগের পর্ব: আল্লাহ কেন পথভ্রষ্ট করেন? | সূচীপত্র দেখুন প্রশ্ন: এমনও অনেকে আছে, যারা ইসলামের নামও শোনেনি, যাদের কাছে কুরআন পৌঁছায় নাই, তাদের কী হবে? তারা কেন জাহান্নামে যাবে? তাদের কী দোষ? কোথায় খোদার ন্যায়বিচার? নাস্তিকদের একটা কমন প্রশ্ন এটা। এবং প্রশ্নটা অবশ্যই অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মুসলমানই ইসলামকে যৌক্তিক ও দার্শনিক মানদণ্ডে যাচাই করে তারপর সত্য হিসেবে গ্রহণ করে মানে না, বরং তারা মানে বাপ-দাদার ধর্ম হিসেবে, (অন্ধ)বিশ্বাসের বস্তু হিসেবে। আর তাই এসকল প্রশ্নের যৌক্তিক সত্য জবাবও তারা দিতে পারেন না। দেবেনই বা কিভাবে, নিজেই তো জানেন না! উপরন্তু নিজের (অন্ধ)বিশ্বাস টিকিয়ে রাখার জন্য গোঁজামিলে পরিপূর্ণ ভুলভাল ব্যাখ্যা হাজির করেন। তাই তারা বলেন, “মুসলমান না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না। অমুসলিম মাত্রেই জাহান্নামী”, ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ একটা পতিতালয়ে যে মেয়েটির জন্ম হয়, সে মেয়েটি কী দোষ করেছিল তাহলে? ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে এমন সব প্রশ্নকে দূরে ঠেলে “মুসলিম না হলে জান্নাতে যেতে পারবে না ব্যস” বলে বসেন। অথচ জন্ম ও বেড়ে ওঠার উপর কারো হাত নেই। দুনিয়ার প্রতিটা মানুষই ভিন্ন ভ

আত্মদর্শন | অনন্তের পথে

আগের পর্ব: জ্ঞানের জগত ও হৃদয়ের জগত | সূচীপত্র দেখুন আমি কে? “I am not this hair, not this skin But the soul that lies within.” - Maulana Rumi আমি কে - এই প্রশ্ন যুগে যুগে দার্শনিকদেরকে চিন্তিত করেছে। অনেকে বলেছে, মানব মস্তিষ্কেই কেবল আমিত্বের অনুভূতি বিদ্যমান। কথা হয়ত সত্য। তবে যেহেতু তারা ক্বলবের জগত সম্পর্কে বেখবর, তাই তারা তাদের সীমিত জ্ঞানবৃত্তের ভিতরেই উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে। মানুষের আত্মা হলো আসল খলিফা وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ (١٧٢) أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ (١٧٣) “আর (হে রাসূল!) যখন আপনার রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বহির্গত করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং তাদের নিজের ওপর তাদেরকে সাক্ষ্য করলেন; (তাদেরকে প্রশ্ন করলেন,) আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল, অবশ্যই, আ