দ্বিতীয় ভাগ: দার্শনিকের কুরআন যাত্রা
| |
পর্ব-১: সূরা ইখলাস ও নিরপেক্ষ মন
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ (١)
اللَّهُ الصَّمَدُ (٢)
لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ (٣)
وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ (٤)
ক্বুল (বলো)!
হু আল্লাহু আহাদ (তিনিই আল্লাহ, একক)!
আল্লাহুস সামাদ (আল্লাহ অমুখাপেক্ষী)।
লাম ইয়ালিদ ওয়ালাম ইয়ুলাদ (তিনি কাউকে জন্ম দেননি, এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি),
ওয়ালাম ইয়াকুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ (আর কোনোকিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়)।
অর্থাৎ, আল্লাহ একক, অমুখাপেক্ষী, জন্ম দেয়া-নেয়ার ঊর্ধ্বে, এবং তাঁর সাথে তুলনাযোগ্য কিছু থাকতে পারে না। আমরা যখন নিরপেক্ষভাবে পরম স্রষ্টাকে নিয়ে চিন্তা করেছি, তখন শেষে এসে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছি। এবং কী আশ্চর্য, কুরআন সে কথারই প্রতিধ্বনি করছে। সে কথাই ঘোষণা করছে। এতটুকুই একজন নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত দার্শনিকের পক্ষে কুরআনের উপর আস্থা সৃষ্টি হবার জন্য যথেষ্ট। এতটুকুই যথেষ্ট বোঝার জন্য যে, কুরআন পরম স্রষ্টার পক্ষ থেকে পাঠানো দিক-নির্দেশিকা: পথ-প্রদর্শক গ্রন্থ, স্রষ্টার বাণী।
কিন্তু তবুও নানান প্রশ্ন মনে খেলে যায়। কুরআন কি সত্যের সন্ধানে দার্শনিক যাত্রাকে সমর্থন করে? কুরআন কি যুক্তিবাদী? ইত্যাদি আরো কত প্রশ্ন।
এতো গেল নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত মনের চিন্তা। অপরদিকে দেখুন প্রভাবিত মন কিভাবে চিন্তা করে:
নাস্তিক: “কুরআন কি বিজ্ঞানের ওমুক থিয়োরি সমর্থন করে? কুরআন কি মানবতাবাদী, নাকি জঙ্গীবাদী?”
মুসলমান: “বিজ্ঞানের এই যুগে কুরআনের মধ্যে বিজ্ঞান দেখাতে না পারলেতো লজ্জার বিষয়। যেভাবেই হোক, কুরআনে বিজ্ঞান খুঁজতেই হবে। কুরআনে কি বিগ ব্যাং আছে? কুরআনে কি পৃথিবী গোলাকার? নাস্তিকদের সব প্রশ্নের মোক্ষম জবাব দিতে পারব তো?”
প্রভাবিত মনের চিন্তার ধরনই এমন। কিন্তু আপনিতো দার্শনিক। আপনার ডানপাশে মুসলমান বসে বিতর্কে জেতার জন্য কুরআন পড়ছে। আর বামপাশে নাস্তিক বসে কুরআন পড়ছে ইসলামকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য। ওদের তর্ক-বিতর্ক আপনার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। ওদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আপনি কুরআনে যাত্রা করছেন না। আপনি কুরআনে যাত্রা করছেন আপনার নিজের মত করে, নিজের জন্যে।
তাই আপনার নিরপেক্ষ মন প্রথমেই কুরআনকে প্রশ্ন করেছে: কুরআন কি দার্শনিক মুক্তচিন্তার সমর্থক? কুরআন কি যুক্তিবাদী? যদি তা হয়, তাহলে আরো পড়ে দেখব। আরো গভীরে যাব। কিন্তু যদি যুক্তিবিরোধী হয়, মুক্তচিন্তার সুযোগ না দেয়, তাহলে সূরা ইখলাস থাকা সত্ত্বেও কুরআন মূল্যহীন হয়ে পড়বে একজন দার্শনিকের কাছে।
পাঠক! আপনার মনকে প্রভাবিত করার জন্য আছে গুগল-ফেইসবুক-ইউটিউব, আস্তিক-নাস্তিক যত বিতর্ক, টেলিভিশন, বিভিন্ন বই আর সর্বোপরি পরিবার ও সমাজ। অপরদিকে আপনার মনকে নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত রাখার জন্য কে আছে? শুধু আপনি আছেন। আর আছেন পরম স্রষ্টা। আপনিতো আর নিজেকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য জঙ্গলে চলে যেতে পারবেন না! কিংবা মগজটাকে পানিতে ধুয়েও নিরপেক্ষ করতে পারবে না! বরং আপনাকে ধর্ম ও নাস্তিকতার যত ব্রেইনওয়াশিঙের মধ্যে থেকেই নিজের নিরপেক্ষ মনটাকে ধরে রাখতে হবে। এটা একটা অবিরত সংগ্রাম। অতন্দ্র প্রহরীর মত নিজের মনকে পাহারা দিতে হবে। ব্যর্থ হলেই আপনার দার্শনিক সত্তার মৃত্যু ঘটবে। আপনি আবারো হয়ে পড়বেন প্রভাবিত মন। আর প্রভাবিত মন কখনো সত্যকে খুঁজে পায় না।
পাঠক! এই বইটি তাই যতটা না দর্শনের আলাপ, তারচেয়ে বেশি হলো নিজেকে নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত রাখার সংগ্রাম। কেননা, সত্য তো সদা প্রকাশিত, উজ্জ্বল আলোর মত। সত্য তো লুকিয়ে নেই যে তাকে আবিষ্কার করতে হবে। বরং আমাদের বুদ্ধিমত্তা ও হৃদয়কে আমরা এতটাই প্রভাবিত করে ফেলেছি যে, প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মের সানগ্লাস দিয়ে সবকিছু দেখি। তাই সাদাচোখে যে সত্যটি কেমন, তা-ই জানা হয়ে ওঠে না।
তাই পাঠকের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আস্তিকতা-নাস্তিকতাসহ সবরকম পক্ষপাতিত্বের চশমা চোখ থেকে চিরতরে খুলে ফেলার সংগ্রাম হিসেবে এই বইটিকে ব্যবহার করুন। তারপর সেই সাদাচোখে এই বইটিকে আবার পড়ুন, পড়ুন কুরআন, এবং এগিয়ে যান মহাসত্যের পথে।
আর আপনি যদি নিজেকে পুরোপুরি নিরপেক্ষ করতে সক্ষম হন, তাহলে এই বইটিকে বন্ধ করে রাখুন: এই বইয়ের আর কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা আপনার চোখ দিয়ে আপনি যেদিকেই তাকাবেন, শুধু সত্যই দেখবেন। আপনার মন দিয়ে আপনি যা-ই ভাববেন, সত্যই ধরা দেবে আপনার কাছে। যেমনটি একজন সাধক বলেছেন: “ভালোবাসার সন্ধান করা তোমার আসল কাজ নয়। বরং ভালোবাসার বিরুদ্ধে তুমি যত দেয়াল গড়ে তুলেছ, সেগুলো খুঁজে ভেঙে ফেলাই হলো তোমার কাজ।”
_______________________________
“জ্ঞানের প্রধানতম হাতিয়ার যুক্তি ও দর্শন।
সত্য ধর্ম, যুক্তি ও দর্শন-বিরোধী হতে পারে না।”
আপনার মতামত শেয়ার করুন।
পরের পর্ব: কুরআনের দর্শন | সূচীপত্র দেখুন
এটি বইয়ের দ্বিতীয় ভাগ। প্রথম ভাগ, "দার্শনিকের স্রষ্টাভাবনা" না পড়ে থাকলে পড়ে আসুন এখানে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত জানান...