আগের পর্ব: কুরআন কি যুক্তিবাদী? | সূচীপত্র দেখুন
বিশ্বাস একটি বাংলা শব্দ। এই প্রসঙ্গে পাঠক, আপনার কাছে একটি প্রশ্ন করতে চাই: বিশ্বাস, ধারণা, অনুমান, কল্পনা – সবগুলোর অর্থ কি একই, নাকি সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে? “আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি”, “আমি আল্লাহকে ধারণা করি”, “আমি আল্লাহকে অনুমান করি”, “আমি আল্লাহকে কল্পনা করি” – চারটা কথা কি একই অর্থ বুঝায়? নিশ্চয়ই না!
একইভাবে “আমি আল্লাহকে চিনি” আর “আমি আল্লাহকে জানি” – দুইটা কথা কি ১০০% একই অর্থ বুঝায়? নিশ্চয়ই না। তাহলে পাঠক, ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আমরা কোন ক্ষেত্রে কোন শব্দ ব্যবহার করব, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, এই পর্যায়ে এসে আমরা একটুখানি ভাষার চর্চা করব এবং দেখব যে, বিভিন্ন শব্দের উপযুক্ত ব্যবহার কীরকম।
তুমি পরীক্ষায় ভালো করবে, এই কল্পনা আমি করি বসে বসে (কল্পনা = শুধুই আশা, বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক নাও থাকতে পারে)।
আমার ধারণা তুমি পরীক্ষায় ভালো করবে (ধারণা = ছাত্রকে স্বল্প পর্যবেক্ষণ করে পাওয়া অনিশ্চিত সিদ্ধান্ত)।
আমার বিশ্বাস তুমি পরীক্ষায় ভালো করবে (বিশ্বাস = ছাত্রকে ভালোমত পর্যবেক্ষণ করে সৃষ্টি হওয়া আস্থা + আশা)।
আমি জানি তুমি ভালো করবে (জানি = শতভাগ নিশ্চয়তা)।
পাঠক, আশা করি “কল্পনা, ধারণা, বিশ্বাস ও জানা” এই চারটার পার্থক্য পরিষ্কার হয়েছে। “বাস্তবতার সাথে সম্পর্কহীন কল্পনা” হলো সবচেয়ে নিচের স্তর। আর “নিশ্চিত বাস্তবতার জ্ঞান” হলো সবচেয়ে উপরের স্তর। এবার আমরা এটার আলোকে “বিশ্বাস” শব্দটাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব এবং দেখব যে, পরম স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার ক্ষেত্রে বাংলায় বিশ্বাস শব্দটা ব্যবহার করা উপযুক্ত, নাকি কল্পনা শব্দটা ব্যবহার উপযুক্ত? নাকি ধারণা, অনুমান, জানা – কোনটা? আসুন দেখি।
নিশ্চিত বিষয়ের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বাস শব্দটা ব্যবহার করি না। আপনি কি কখনো নিজের সন্তানের সম্পর্কে আরেকজনকে বলবেন যে, “আমার বিশ্বাস এটা আমার সন্তান”?? নিশ্চয়ই না! কিন্তু কেন? কারণ এটা আপনার বিশ্বাস না, এটা আপনার জ্ঞান। আপনি “জানেন” যে এটা আপনার সন্তান।
আপনি কি বলেন যে, আমার বিশ্বাস আমার একটা বাড়ি আছে, আমার বিশ্বাস আকাশে চাঁদ আছে, আমি বিশ্বাস করি অক্সিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচে না, আমি বিশ্বাস করি…। তেমনি আপনি বলেন না, “আমার বিশ্বাস এটা আমার সন্তান”। যদি বলেন, তখন মানুষ আপনাকে বলবে, “ও আচ্ছা, তারমানে তুমি শিওর না? এটা অন্য কারো সন্তানও হতে পারে? তোমার স্ত্রী কি তাহলে…।”
আবার ধরুন, পুরুষ মানুষের ক্ষেত্রে নাহয় এধরণের অনিশ্চয়তার সুযোগ আছে। কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে? যে নারী নিজে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেছেন দশ মাস, তারপর জন্ম দিয়েছেন, সেই নারী কি কখনো বলতে পারে, “আমার বিশ্বাস এটা আমার সন্তান?” সন্তানের বাপ যে-ই হোক না কেন, মা যে উনিই, এতে সন্দেহ নেই। এটা ‘বিশ্বাস’ না, এটা ‘নিশ্চিত জ্ঞান'।
পাঠক! আসুন, আবারো সেই দার্শনিক পন্থায় নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করি। এখন আপনি নিজেই দুইটা পক্ষ সাজবেন। এবং নিজের মনেই নিজের সাথে যুক্তিতর্ক করবেন।
‘বিশ্বাস’ বিতর্ক
পক্ষ-১: “মায়ের ক্ষেত্রে বিশ্বাস বলা যাবে না, কারণ সে নিজচোখে দেখেছে জন্ম দেয়ার সময়। তবে বাবার ক্ষেত্রে কিন্তু বিশ্বাস বলার সুযোগ থাকতেও পারে।”
পক্ষ-২: হ্যাঁ, কথা সত্য। কিন্তু কোনো সন্তান কি কখনো বলে: আমার বিশ্বাস এটা আমার মা? না। কারণ সে “জানে” যে এটা তার মা। অতএব, বিশ্বাস (belief) ও জ্ঞান (knowledge) এর মধ্যে পার্থক্য আছে।
পক্ষ-১: সন্তানের ক্ষেত্রেও কিন্তু বিশ্বাস বলা যেতে পারে। কারণ সেতো আর নিজচোখে নিজেকে জন্ম নিতে দেখে নাই কিংবা জন্মের ভিডিওচিত্র (অর্থাৎ প্রমাণ) দেখে নাই।
পক্ষ-২: তারমানে আপনি নিজের মাকেও অস্বীকার করতে চান?
পক্ষ-১: আমি তো সেটা বলিনি। আমি যা বলিনি, তা আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন কেন? এটা ফ্যালাসি। তাছাড়া, যুক্তির মাঝে ব্যক্তিগত বিষয় টেনে আনাটাও যুক্তির নিয়ম বহির্ভুত কাজ, অর্থাৎ ফ্যালাসি (fallacy - অপযুক্তি)।
পক্ষ-২: হুম, ঠিক আছে। মেনে নিলাম। কিন্তু ঐ মহিলা আপনার মা হোক বা না হোক, অ্যাট লিস্ট আপনার যে একজন মা আছে, তা তো স্বীকার করেন? এমনকি আপনি তাকে না চিনলেও?
পক্ষ-১: হুম, তা স্বীকার করতেই হবে।
পক্ষ-২: কেন স্বীকার করতে হবে? এখন যদি বলি, আপনিতো আপনার জন্মের ভিডিও দেখেন নাই, চাক্ষুষ প্রমাণও নাই; তাহলে একজন মা-ই যে আপনাকে জন্ম দিয়েছে, এটাই বা নিশ্চিত করে বলছেন কিভাবে? হতেও তো পারে আপনি আকাশ থেকে পড়েছেন, কিংবা মাটি ফুঁড়ে বের হয়েছেন, কিংবা বানরের পেট থেকে বের হয়েছেন কিন্তু মানুষরূপে?
পক্ষ-১: এগুলো বাজে কথা, ফালতু যুক্তি। কারণ আমাদের পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানি যে, মানুষের সন্তান মানুষই হয়। বাঘের সন্তান বাঘই হয়। বানরের সন্তান বানরই হয়। বানরের সন্তান মানুষ হয় না, কিংবা বাঘের সন্তানও মানুষ হয় না। এছাড়াও, জন্মদান প্রক্রিয়া ছাড়া কোনো মানুষকে আমরা সৃষ্টি হতে (অর্থাৎ অস্তিত্বমান হতে) দেখি না। অতএব, যদিও আমি নিজের জন্ম নিজের চোখে দেখি নাই, কিন্তু যুক্তির মাধ্যমে আমি নিশ্চিত জানি যে, অবশ্যই একজন নারীর গর্ভে আমার জন্ম হয়েছে।
পক্ষ-২: সুন্দর যুক্তি! তাহলে আপনার নিজের চোখে সরাসরি দেখা জিনিসও যেমন “নিশ্চিত জ্ঞান”, তেমনি এই চোখে দেখা জিনিসের উপর ভিত্তি করে যুক্তি খাটিয়েও “নিশ্চিত জ্ঞান” পাওয়া যায়। যেমন, আপনি চোখ দিয়ে দেখেছেন মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এটা আপনার চাক্ষুষ জ্ঞান। এই চাক্ষুষ জ্ঞানের উপর যুক্তিপ্রয়োগ করে আপনি অদেখা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করলেন: “আপনাকেও অবশ্যই একজন নারী জন্ম দিয়েছিলেন।” তারমানে দেখা যাচ্ছে, শুধু চোখের দেখাই জ্ঞান নয়, বরং যুক্তি দ্বারা অদেখা বিষয়েও নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করা যেতে পারে।
পক্ষ-১: হুম, তো? কিন্তু এর সাথে এক আল্লাহতে ঈমান এর সম্পর্ক কী? আমি তো আল্লাহতে বিশ্বাস করি।
পক্ষ-২: এখানেইতো সমস্যা। আপনি কখনো বলেন না যে “আমি বিশ্বাস করি একজন নারী আমাকে জন্ম দিয়েছে”। বরং আপনি বলেন, “আমি ‘জানি’ যে একজন নারী আমাকে জন্ম দিয়েছেন”। অর্থাৎ, এটা আপনার বিশ্বাসের বিষয় নয়, এটা আপনার নিশ্চিত জ্ঞান। তাহলে এবার আমাকে বলুন, পরম স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে কি আপনি পুরোপুরি নিশ্চিত নন? সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে নাকি যে বলবেন, আমি “বিশ্বাস করি” আল্লাহ আছে? নাকি বলবেন, আমি “জানি” আল্লাহ আছেন?
পক্ষ-১: উমম… তাহলে তো বিশ্বাস বলা যাবে না। কারণ আমি যদিও স্রষ্টাকে চাক্ষুষ দেখি নাই, কিন্তু তাঁর বিভিন্ন সৃষ্টি দেখে মাথার মধ্যে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করে অকাট্যভাবে নিশ্চিত হয়েছি যে, মহাবিশ্বের একজন পরম স্রষ্টা অবশ্যই আছেন। এক্ষেত্রে বিশ্বাসের কোনো সুযোগ নাই। এটা অকাট্য জ্ঞান, নিশ্চিত জ্ঞান। তাহলেতো “আল্লাহতে বিশ্বাস” না বলে “আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে অকাট্য জ্ঞান/ দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হওয়া” এই টাইপ কিছু বলা উচিত।
ব্যস, আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলাম। সমাধান পেয়ে গেলাম। কিন্তু পাঠক! লক্ষ্য করুন, উপরের দুইটা পক্ষই কিন্তু আপনার নিজের মনের ভিতরে, তাই মারামারির কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু এটাই যদি হত, ধরেন, একজন নাস্তিক বনাম আস্তিক বিতর্ক?
যখনই নাস্তিক বলত যে, সন্তানের ক্ষেত্রেও ‘বিশ্বাস’ বলা যায়, তখন আস্তিক বলত, তারমানে আপনি নিজের মাকে অস্বীকার করতে চান? এরপর মারামারি শুরু হয়ে যেত–
“আপনি কী বলতে চান, হ্যাঁ? মুখ সামলে কথা বলুন।”
– “মুখ সামলে আর বলব কী, তুই তো নিজের মাকেই বিশ্বাস করি না, তোর তো জন্মের ঠিক নাই।”
(এরপর হাতাহাতি-মারামারি চলবে)।
একারণেই সবচেয়ে ফলপ্রসু বিতর্ক হলো নিজের মনে নিজের সাথে নিজেই বিতর্ক করা। নিজেই দুইটা পক্ষ সেজে বিতর্ক করা, আবার নিজেই তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ বিচারক হওয়া। আর এটাই জ্ঞান অর্জনের দার্শনিক পন্থা।
_______________________________
নিশ্চিত জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘বিশ্বাস’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় না।
“আল্লাহতে বিশ্বাস” - একটি অনুপযুক্ত কথা।
আপনার মতামত লেখক-পাঠকদের সাথে শেয়ার করুন।
পরের পর্ব: বিশ্বাস, জ্ঞান ও ঈমান | সূচীপত্র দেখুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত জানান...