আগের পর্ব: বিশ্বাস, জ্ঞান ও ঈমান | সূচীপত্র দেখুন
প্রিয় পাঠক,
এবার “ঈমান ও বিশ্বাস” সংক্রান্ত আলোচনাটা উদারমনে আরো একবার চোখ বুলিয়ে আসুন। আসুন চিন্তা করি, আমরা কোন স্তরে আছি? বিশ্বাস, জ্ঞান, নাকি ঈমান? চারিদিকে তাকিয়ে দেখুন, কত অজস্র মানুষ বলছে, “ধর্ম হলো বিশ্বাসের বিষয়, এখানে কোনো যুক্তি চলবে না”। অর্থাৎ, সমাজের মেজরিটি মানুষই বাপ-দাদার দেখাদেখি ধর্মপালন করে, এবং তাদের এসব ধর্মচর্চার কোনো জ্ঞানগত ভিত্তি নেই। আর জ্ঞান না থাকায় তারা হক্ব তথা সত্যকে খুঁজে পায় না।
কিন্তু সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের, যিনি আমাদেরকে বিশ্বাসের স্তর পেরিয়ে জ্ঞানের স্তরে আসার তাওফিক দিয়েছেন। যেকারণে আজ আমরা উদার হৃদয়ে মুক্তমনে লিখছি: স্রষ্টাভাবনা।
পাঠক, তাহলে দেখুন, অধিকাংশ মানুষই ধর্মকে অন্ধবিশ্বাসে আঁকড়ে ধরে, সেটা সত্য কি মিথ্যা তা তারা যাচাই করে না, জানে না, জানতে চায়ও না। খুব অল্পকিছু মানুষই জ্ঞানের স্তরে ওঠার সাহস করে: নিজের বাপ-দাদার ধর্মকে প্রশ্ন করা শেখে। নিরপেক্ষ, অপ্রভাবিত মনে স্রষ্টাভাবনা করার সাহস করে। আপনি-আমি সেই অল্পকিছু মানুষেরই অন্তর্ভুক্ত, আলহামদুলিল্লাহ। যেকারণে আজকে প্রিয় পাঠক, আপনি নিজেকে নতুন করে মুসলিম ভাবছেন। আমি নিজেকে নতুন করে মুসলিম মনে করছি। কেননা, এতদিন যদিও ইসলাম-ই চর্চা করে এসেছি, কিন্তু সেটাতো ছিল বিশ্বাসের স্তরে, জ্ঞানের স্তরে নয়। আজকে আমাদের অকাট্য জ্ঞান অর্জন হয়েছে যে আল্লাহ হক্ব, কুরআন হক্ব। অতএব, আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম।
কিন্তু পাঠক, এখন যদি আমরা রাসুল (সা.) এর কাছে গিয়ে বলতাম যে, আমরা ঈমান এনেছি, তখন তিনি কী বলতেন? ৪৯:১৪ আয়াতের মত করে নিশ্চয়ই তিনি আমাদেরকে বলতেন যে, “না, তোমরা মুসলিম হয়েছ মাত্র, কিন্তু ঈমান তোমাদের ক্বলবে এখনও প্রবেশ করেনি।”
প্রিয় পাঠক!
হয়ত ভাবছেন যে, উৎসের সন্ধানে দার্শনিক যাত্রা করে জ্ঞানের স্তরে আল্লাহ ও কুরআনকে সত্য বলে জানাই কি যথেষ্ট নয়? আরো কি পথ বাকী? ঈমানই তো এখনো অর্জন হলো না! নিরাপত্তা ও প্রশান্তিও তো আজও অর্জন হলো না! তবে কী সেই উপায়, যা অবলম্বন করলে আমরা ঈমান অর্জন করতে পারব? “ক্বলব-এ ঈমান প্রবেশ করা” কথাটারই বা মানে কী? আমরাতো তাত্ত্বিকভাবে পরম স্রষ্টা ও তাঁর কিতাবকে সত্য বলে মেনেই নিলাম। তবুও কি পথ চলার বাকী আরো!
জ্বী, প্রিয় পাঠক, সেই পথটিই হলো অনন্তের পথে যাত্রা। যেই যাত্রার কোনো শেষ নেই। জ্ঞান স্তরের সীমা আছে, কিন্তু ঈমান স্তরের সীমা নেই। ঈমান স্তর আমাদেরকে নিয়ে যায় অনন্ত পথের যাত্রায়। এমন এক জগতে, যেখানে মানব মস্তিষ্ক (human brain) তার যুক্তি ও দর্শনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে সীমানায় পৌঁছে যায়। ঐ সীমানার পর থেকে শুরু হয় ক্বলবের জগত। জ্ঞান স্তরে জ্ঞান অর্জনের হাতিয়ার যেমন যুক্তি ও দর্শন, তেমনি ঈমান স্তরে ঈমান অর্জনেরও নিশ্চয়ই হাতিয়ার আছে, পদ্ধতি আছে। সেই হাতিয়ারগুলি কী? সেটা পথই বলে দেবে। আমি বড়জোর পথ চিনিয়ে দিতে পারি। কিন্তু পথ হাঁটা? সেতো পথিকের দায়িত্ব।
কিন্তু পাঠক, আমাদের অবস্থা ঐ ছেলেটির মতই। ১৮ বছর বয়সে সে পর্যবেক্ষণ ও বুদ্ধি দিয়ে জেনেছে যে, এই মা-ই তার জন্মদাত্রী। কিন্তু মায়ের প্রতি কি তার ভালোবাসা জেগেছে, পাঠক? আমরা যখন প্রথম ভাগে দার্শনিক স্রষ্টাভাবনার শেষে পরম স্রষ্টাকে চিনেছি, তাঁর বৈশিষ্ট্য জেনেছি, জেনেছি যে কুরআনে বর্নিত আল্লাহ তায়ালাই পরম স্রষ্টা, প্রকৃত ইনফিনিটি (true infinity) – তখন কি আমাদের মাঝে খোদাপ্রেম জেগেছে?
নাহ। যদি প্রেম জাগতই, তবে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক কিংবা অন্তঃধর্মীয় বিতর্কে লিপ্ত হতাম না। সেই ছেলেটির মতই আমাদের অবস্থা: ১৮ বছর বয়সে জ্ঞান হয়েছে বটে, কিন্তু জ্ঞান পড়ে রয়েছে জ্ঞানের জায়গায়, আর সে পড়ে রয়েছে প্রবৃত্তির সুখ মিটাতে নানারকম নেশার জগতে বখাটেদের সাথে মারামারিতে। আরো বহুবছর এই জগতে থেকে একদিন যখন তার বয়স ৩৫ হয়, ক্লান্ত শ্রান্ত সে তখন মায়ের কাছে ফিরে যায়। বলে, মা, তোমাকে ভালোবাসি।
পাঠক, আমরাও হয়ত একদিন সমস্ত ইন্টেলেকচুয়াল বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে অসীম অনন্ত পরম স্রষ্টার দরবারে কপাল ঠেকিয়ে বলব, আয় আল্লাহ! তোমাকে ভালোবাসি।
কিন্তু সেজন্য ধৈর্য্য ধরতে হবে। এবং জ্ঞানের জগতে আমাদেরকে আরো যোগ্য হতে হবে। সঠিক পদ্ধতিতে যুক্তি ও দর্শনের চর্চা করতে হবে। আর সেই চর্চা নিয়েই রচিত হয়েছে এই বইয়ের তৃতীয় ভাগ: যুক্তির কাঠগড়ায় ইসলাম। এখানে মায়ের পরম মমতার আবেগ নেই। কিন্তু এটাও ঠিক যে, বাইরে সন্ত্রাসীদের সাথে যুদ্ধ করে তাদেরকে পরাজিত করে যখন ছেলেটা দুটো পয়সা উপার্জন করে, তখন সেটা সে মায়ের পায়ের কাছেই এনে দেয়। গল্পটা যেন ঠিক এভাবেই হতে হবে, অন্যভাবে নয়। তাই আস্তিক-নাস্তিক বিতর্কও আমাদের জানতে হবে। পারদর্শী হতে হবে প্রয়োজনীয় সব যুক্তি ও দর্শনে। আর সেই যুক্তি ও দর্শনের চর্চাই আমাদের সামনে খুলে দেবে ঈমানের দরজা। তখনই কেবল প্রশান্তি ও নিরাপত্তার সেই সুমহান গল্পটি রচিত হবে। তাই আপনার আবেগকে সংযত করুন, প্রিয় পাঠক! এখন আমরা যুক্তিতর্কের রুক্ষ-শুষ্ক ময়দানে দীর্ঘ ক্লান্তিকর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছি।
_______________________________
নিছক জ্ঞানচর্চায় ঈমান অর্জন হয় না।
তবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চারও গুরুত্ব আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ঈমানের ভিত্তি।
আপনার ভাবনা শেয়ার করুন।
তৃতীয় ভাগ: যুক্তির কাঠগড়ায় ইসলাম | সূচীপত্র দেখুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত জানান...