আগের পর্ব: বহুল ব্যবহৃত ফ্যালাসি: কোট মাইনিং | সূচীপত্র দেখুন
প্রিয় পাঠক!
এ পর্যন্ত যুক্তি ও দর্শনের অনেক কিছুই শিখলাম আমরা। তাহলে এবার নিজেরাই নিজেদের একটা পরীক্ষা নেই, কী বলেন? এখন আমি এক বিখ্যাত বাংলাদেশী নাস্তিকের আর্গুমেন্ট তুলে ধরব আপনাদের সামনে। একটু ধৈর্য্য ধরে পড়বেন, আর খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করবেন। তারপর দেখুনতো, ফ্যালাসিটা বের করতে পারেন কিনা?
ম্যাগাজিনের নাম: “যুক্তি।”
প্রবন্ধের নাম: ঈশ্বরই কি সৃষ্টির আদি বা প্রথম কারণ?
লেখক: অভিজিৎ রায়।
“ইদানীংকালে ‘কালাম কসমলজিকাল আর্গুমেন্ট’ (Kalam Cosmological Argument) নামে একটি দার্শনিক যুক্তিমালা সাধারণ বিশ্বাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।… ধারাটিকে নিচের চারটি ধাপের সাহায্যে বর্ণনা করা যায়:
১. যার শুরু আছে, তার পেছনে একটি কারণ রয়েছে।
২. আমাদের আজকের এই মহাবিশ্বের একটি উৎপত্তি আছে।
৩. সুতরাং এই মহাবিশ্বের পেছনে একটি কারণ আছে।
৪. সেই কারণটিই হল ‘ঈশ্বর’।
দার্শনিকেরা কালামের যুক্তিকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন বিভিন্ন সময়েই। এখানে ‘বাহুল্য বিধায়’ সেগুলোর পুনরুল্লেখ করা হল না। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার উল্লেখ না করলেই বোধ হয় নয়। সবকিছুর পেছনেই ‘কারণ আছে’ বলে পেছাতে পেছাতে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের কাছে গিয়ে হঠাৎ করেই থেমে যান। এ সময় আর তারা যেন কোনো কারণ খুঁজে পান না। মহাবিশ্বের জটিলতাকে ব্যাখ্যা করার জন্য যদি ঈশ্বর নামক একটি সত্তার আমদানি করতেই হয়, তবে সেই ঈশ্বরকে ব্যাখ্যা করার জন্য একই যুক্তিকে আরেকটি ‘ঈশ্বরক’কে কারণ হিসেবে আমদানি করা উচিৎ। এভাবে আমদানির খেলা চলতেই থাকবে একের পর এক, যা আমাদেরকে অসীমত্বের দিকে ঠেলে দেবে। এই ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই সকল বিশ্বাসীর কাছে আপত্তিকর। তাই তারা নিজেরাই ‘সবকিছুর পেছনেই কারণ আছে’ এই স্বতঃসিদ্ধের ব্যতিক্রম হিসেবে ঈশ্বরকে কল্পনা করে থাকেন আর সোচ্চার ঘোষণা করেন – ‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের পেছনে কোনো কারণের প্রয়োজন নেই।’ সমস্যা হলো যে, এই ব্যতিক্রমটি কেন শুধু ঈশ্বরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে কেন নয়, এর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেন না।”
পাঠক! এটাতো আপনার পরীক্ষা। অভিজিৎ রায়ের ফ্যালাসিটা ধরতে পেরেছেন? এখনো না পারলে আরেকবার পড়ে বের করার চেষ্টা করুন। তারপর নিচের উত্তরটির সাথে মিলিয়ে দেখুন:
কালাম কসমোলজিকাল আর্গুমেন্টের ১ নং প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “যার শুরু আছে, তার পেছনে একটি কারণ রয়েছে।” লক্ষ্য করুন, বলা হয়েছে “যার শুরু আছে”। আর অভিজিৎ রায় কী বললেন? তিনি বললেন: “সবকিছুর পেছনেই ‘কারণ আছে’ বলে পেছাতে পেছাতে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের কাছে গিয়ে হঠাৎ করেই থেমে যান।” অথচ কালাম আর্গুমেন্টের ১ নং প্রস্তাবে তো বলা হয়নি যে, “সবকিছুর পেছনেই কারণ আছে।” বরং আর্গুমেন্ট শুরুই হয়েছে এই প্রস্তাব দিয়ে যে: “যার শুরু আছে, তার পেছনে একটি কারণ রয়েছে।” কিন্তু অভিজিৎ রায় সেটাকে বানিয়ে দিলেন, “সবকিছুর পেছনেই কারণ আছে”।
উদ্ধৃত কালাম আর্গুমেন্টে যদি বলা হত যে, “সবকিছুর পেছনে কারণ আছে”, তাহলে সৃষ্টি ও স্রষ্টা উভয়েই সেই “সবকিছুর” অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। তখন আর পরম স্রষ্টাকে first cause বা আদি কারণ হিসেবে দেখানো যেত না। একারণেই কালাম আর্গুমেন্টের ভাষা খুব সতর্কভাবে তৈরী করা হয়েছে: “যাকিছুর শুরু আছে…” এভাবে। যেন নাস্তিকরা এর ভিতরে ঈশ্বরকে (তথা পরম স্রষ্টাকে) অন্তর্ভুক্ত করতে না পারে। কারণ, কালাম আর্গুমেন্টের ১ নং প্রস্তাবের ভিতরে ঈশ্বরকে অন্তর্ভুক্ত করতে গেলে –
১. প্রথমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে হবে
২. তারপর দেখাতে হবে ঈশ্বরের শুরু ছিল/আছে
৩. তারপর বলতে হবে যে ঈশ্বরও তার সৃষ্টির সাথে কালাম আর্গুমেন্টের ১ নং প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু একজন নাস্তিক কখনোই সেটা প্রমাণ করতে পারবে না। সেতো কখনোই প্রমাণ করবে না যে ঈশ্বর/পরম স্রষ্টা আছে। আর তার শুরু আছে – এটা প্রমাণ করা তো দূরের কথা। তাহলে পাঠক! দেখা যাচ্ছে যে কালাম আর্গুমেন্টের ১ নং প্রস্তাবের সূক্ষ্মভাবে তৈরী (carefully crafted) ভাষার প্যাঁচে নাস্তিকরা আটকা পড়ে গিয়েছে। এখন অভিজিৎ রায় কী করবে? এই প্যাঁচ থেকে বের হবার জন্য সে স্ট্রম্যান ফ্যালাসি করবে। আর সেটাই সে করেছে। যেহেতু সে কালাম আর্গুমেন্টের ১ নং প্রস্তাবই পার হতে পারছে না, আটকে যাচ্ছে, সেহেতু কালাম আর্গুমেন্টের একটা নিজস্ব ভার্সন তৈরী করে সেটা আস্তিকদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে সে: “সবকিছুর পেছনেই কারণ আছে”। তারপর সেটার যুক্তিখণ্ডন করে জিতে যাচ্ছে! আর সাধারণ দর্শকেরা এই সূক্ষ্ম কারচুপি তথা স্ট্রম্যান ফ্যালাসি ধরতে না পারার কারণে ভাবছে যে, ওরে বাবা, অভিজিৎ রায়তো কালাম আর্গুমেন্টকে একদম ধুয়ে দিল!
প্রতিপক্ষের যুক্তিকে খণ্ডন করতে না পেরে তার যুক্তিটাকে নিজের সুবিধামত পরিবর্তন করে একটা ভার্সন তৈরী করে তারপর সেটাকে পরাজিত করার মাধ্যমে জিতে যাওয়া – এটাই হলো স্ট্রম্যান ফ্যালাসি। কেন স্ট্রম্যান বলা হয়? Straw man মানে খড়ের মানুষ। যেটাকে বাংলায় বলে কুশপুতুল/কুশপুত্তলিকা। জনগণ কারো উপর ক্ষেপলে যখন তাকে সরাসরি মারতে পারে না, তখন একটা খড়ের পুতুলে ঐ লোকের ছবি লাগিয়ে সেটাকে পুড়িয়ে মনের ক্ষোভ ঝাড়ে। এই কাজটাকে কুশপুত্তলিকা দাহ করা বলে। ওখান থেকেই এই ফ্যালাসিটার নাম দেয়া হয়েছে fallacy of straw man। কারণ এখানেও প্রতিপক্ষের যুক্তিকে ঘায়েল করতে না পেরে ঐ যুক্তির একটা সুবিধাজনক ভার্সন তৈরী করে সেটাকে আঘাত করা হয়।
পাঠক! আরো একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করবেন। যেটা আমি আগেও বলেছি, এদেশীয় নাস্তিকরা বেশিরভাগই আমদানী করা অনুবাদ-নাস্তিক। অভিজিৎ রায়ও তার ব্যতিক্রম নন। তার বাক্য গঠন লক্ষ্য করলেই সেটা ধরা পড়ে। “বিশ্বাসীদের কাছে জনপ্রিয়… বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের কাছে গিয়ে… সকল বিশ্বাসীর কাছে…” এভাবে লিখেছেন তিনি। অথচ এটা কি বাংলা ভাষার প্যাটার্ন? নাহ। বরং এটা ইংরেজির প্যাটার্ন। ইংরেজিতে স্রষ্টায় বিশ্বাসীদেরকে believers বলা হয়ে থাকে। আর অভিজিৎ রায় যেহেতু বিদেশ থেকে আমদানী করে অনুবাদ করে নাস্তিক হয়েছেন, সেহেতু সোর্স এর ছাপ রয়ে গেছে উনার লেখায়। উনি যদি মৌলিক চিন্তাশীল নাস্তিক হতেন, যেমনটা ধরুন আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন, তাহলে উনি এভাবে “বিশ্বাসী” লিখতেন না। তখন উনি লিখতেন “আস্তিক”। কিংবা লিখতেন, “খোদায় বিশ্বাসী” বা “স্রষ্টায় বিশ্বাসী”। কিন্তু শুধু ‘বিশ্বাসী’ যে লিখেছেন, ওখানেই চিহ্ন পড়ে আছে উনার অনুবাদ নাস্তিকতার। এ এক দুঃখজনক বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য।
[পাঠক, যুক্তিশাস্ত্র একটি ব্যাবহারিক বিষয়। অতএব, ইন্টারনেটে নাস্তিকদের বিভিন্ন ডিবেইট মনোযোগ দিয়ে দেখুন এবং স্ট্রম্যান ফ্যালাসি শনাক্ত করার চেষ্টা করুন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা বিতর্কের সময় এই ফ্যালাসিটা আমাদের চোখের সামনেই ঘটে যায়, কিন্তু বিতর্কের উত্তেজনায় আমরা সেটা লক্ষ্য করি না। সাংবাদিক মেহদি হাসানের ইন্টারভিউয়ে [QR] রিচার্ড ডকিন্স স্ট্রম্যান ফ্যালাসি করেছিলেন এবং তুখোড় বিতার্কিক মেহদি হাসান সাথে সাথে সেটা ধরেও ফেলেছিলেন। পাঠক, ভিডিওটি দেখে সেটা বের করতে পারেন কিনা, দেখুনতো?
আপনার যুক্তিবিদ্যা চর্চার একটা ভালো ক্ষেত্র হতে পারে নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্সের ফ্যালাসি শনাক্তকরণ। এছাড়াও কালাম কসমোলজিকাল আর্গুমেন্ট ও আমাদের “আটটি প্রস্তাব” এর তুলনামূলক আলোচনা করুন। কালাম কসমোলজিকাল আর্গুমেন্ট যুক্তির বিচারে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু নিরপেক্ষতার বিচারে কেন গ্রহণযোগ্য নয়, তা খুঁজে বের করুন।]
_______________________________
প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে সুবিধামত বিকৃত করাই স্ট্রম্যান ফ্যালাসি।
ভাষার দক্ষতা ছাড়া স্ট্রম্যান ফ্যালাসি শনাক্ত করা কঠিন।
কোনো আর্গুমেন্টে এই ফ্যালাসি শনাক্ত করেছেন কি? দেখুন অন্য পাঠকরা কী ভাবছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আপনার মতামত জানান...